০৯:২৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ০৮ জুন ২০২৫, ২৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
ভোলা-বরিশাল সেতুর দাবিতে মানববন্ধন ভোলা জেলা ওলামা তলাবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বিলুপ্ত করায় বিমানবন্দরে এফবিসিসিএফএএ’র সংবাদ সম্মেলন ক্যারিয়ার বাংলাদেশের গোল টেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত দলিপাড়া ও দেশবাসীকে ঈদ-উল-ফিতরের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন আবু জাফর আলম উত্তরা ১১ নং সেক্টর ও দেশবাসীকে ঈদ-উল-ফিতরের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন অধ্যক্ষ সালাউদ্দিন ভূঁইয়া সেই গুলিবিদ্ধ ইমরান কে দেখতে গেলেন লুৎফুজ্জামান বাবর একাত্তরের ন্যায় ২৪ যোদ্ধারাও পাবে সকল সুবিধা-মুস্তাফিজ সেগুন গুম-খুনের শিকার ও চব্বিশের শহীদ পরিবারকে ঈদ উপহার দিলেন বিএনপি নেতা আমিনুল হক জাতিসঙ্ঘ শূন্য বর্জ্য দিবসে প্রফেসর ইউনূসকে অভিনন্দন জানালেন তুরস্কের ফার্স্ট লেডি চীনা বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার

ঈদুল আযহা , হজ্ব ও কুরবানী-মুফতী হুসাইন বিন জিয়া

মুফতী হুসাইন বিন জিয়া
  • আপডেট সময় : ০৪:৩১:২৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৫ জুন ২০২৩ ৪৪ বার পড়া হয়েছে
ভয়েস অব টাইম অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

ঈদ মানে খুশী, আনন্দ। ঈদ মানে যা ফিরে বারবার আসে। ১০ জিলহজ্ কুরবানীর দিন। আরবের কোন কোন এলাকায় বলে ‘ইয়াওমুন নাহার’, ‘ইয়াওমুল জব্হ’ জবাহ করার দিন। এ ঈদ মূলত হজের ঈদ। কুরবানীর বা বকরী ঈদ। ইসলামের পাঁচটি বুনিয়াদের অন্যতম একটি হলো হজ্ব। কালিমা, সালাত, সিয়াম এ তিনটি সব মুসলিম নর-নারীর জন্য ফরয। আর দুটি হজ্ব ও যাকাত ফরয কেবল সুস্থ ও সঙ্গতিসম্পন্নের জন্য। ঈমানের পরেই সালাত ও সিয়াম। এ দুটি মুমিনের ব্যক্তিগত ইবাদত। এতে তার দৈহিক ও আত্মিক অনুশীলনী, পরিচর্যা ও উৎকর্ষ সম্পৃক্ত।
আর যাকাত ও হজ্বের সাথে সম্পর্ক রয়েছে প্রধানত বান্দার দৈহিক ও আর্থিক পরিচর্যার। আর্থিক ও শারীরিক দিক থেকে সামর্থ বান্দার জন্য জীবনে একবার হজ্ব ফরয। আল্লাহু সুবনাহু তাআলা ইরশাদ করেছেন, (সারমর্ম) “আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে বাইতুল্লাহর হজ্ব সে লোকের ওপর ফরয, যার সে উদ্দেশ্যে পথ অতিক্রমের দৈহিক ও আর্থিক সামর্থ্য রয়েছে।” প্রত্যেক সুস্থ, সাবালক মুসলিম নর বা নারী, যার সফরে যাতায়াতের এবং যাবতীয় অনুষ্ঠান পালনের দৈহিক ও আর্থিক সক্ষমতা আছে এবং হজ থেকে ফিরে আসা পর্যন্ত তার উপর নির্ভরশীল পরিবারবর্গের আবশ্যকীয় ব্যয়ের নির্বাহের ব্যবস্থা রয়েছে, তারই জন্য হজ ফরয। মানুষ আশরাফ‚ল মাখলুকাত- সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ। তার স্বভাব ধর্মই হল পরস্পর-পরস্পরকে ভালোবাসা ও একে অন্যের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করা। কেবল তাই নয়। সৃষ্টির যাবতীয় প্রাণী ও অপ্রাণীর প্রতি তার স্নেহ মমতা ও দয়ার্দ্রতা প্রকাশও তার স্বভাব-ধর্ম। পরিবেশ-পরিমণ্ডল সুস্থ ও স্বাভাবিকতায় রক্ষা করার প্রবণতা তার অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য। অর্থাৎ সৃষ্টির ভারসাম্য রক্ষা করাই তার স্বভাব ধর্ম। এদিক থেকে তার এক সম্পর্ক তার মাবুদের সাথে আর এক সম্পর্ক তার সৃষ্ট বান্দার সাথে। আল্লাহর সাথে তার সম্পর্ককে বলা যায় তাঁর আবদিয়াত বা দাসত্বের সম্পর্ক। মানুষ আল্লাহর সৃষ্ট মাখলুক। তার বান্দা। সে সব সময় সকল অবস্থায় তাঁরই হুকুম পালন করবে, তাঁরই আনুগত্য করে যাবে। এটা মহান স্রষ্টা ও পালনকর্তার প্রতি তার দায়িত্ব ও কর্তব্য। আর বান্দা বা মাখলুকের সাথে তাঁর সম্পর্ককে বলা হয় খিলাফত। সে এ দুনিয়ায় আল্লাহর খলীফা। মাখলুককে সে একান্ত আপন মনে করে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে এর ভারসাম্য রক্ষা করবে। সকল সৃষ্টির প্রতি থাকবে তার সহানুভূতি। তাদের প্রয়োজনে, তাদের মঙ্গলের জন্য সে নিজেকে বিলিয়ে দিবে। অর্থাৎ আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজের মত মনে করে অপরকেও সমান আদরে লালন করবে। তবেই হবে তার খিলাফতের দায়িত্ব পালন।
ধর্ম সাধনার মূল উদ্দেশ্য হল সমগ্র ইচ্ছাশক্তির সাহায্যে মানবীয় অবাধ্য পশুপ্রবৃত্তি বা রিপুগুলোকে সংযত ও সংহত করে বিশ্বপালকের পরম কল্যাণময় ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ। এ ইচ্ছাশক্তিকেই দৃঢ় করার প্রথম সোপান কালিমা বা আল্লাহর একত্বে ও প্রভুত্বে বিশ্বাস স্থাপন করে তাঁরই ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁর প্রদর্শিত পথে নিজেকে পরিচালিত করাই পরবর্তী স্তরের সাধনায় যুুক্ত। বাহ্যিক অনুষ্ঠান সালাত বান্দাকে দুষ্কর্ম ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত রাখে। সিয়াম দেহ ও মনের ক্লেদ দূরীভূত করে। যাকাত সমাজ বিধানে অর্থনৈকি ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা, মানব কল্যাণ ও এর হিতে সহায়তা করে এবং স্বার্থ ত্যাগের মাধ্যমে আল্লাহর পথে নিজেকে বিসর্জন দেয়ার জন্য তৈরী করে। সব শেষে হজ্ব মুমিনের পূর্ণ সাধনার পরিপূর্ণ ইঙ্গিত বহন করে।
হজ্ব পালনকারী আল্লাহর উদ্দেশ্যে দুনিয়ার সব স্বার্থ ত্যাগ করে, সব মায়া কাটিয়ে আল্লাহরই সান্নিধ্যে গিয়ে লাব্বায়িক আল্লাহুম্মা লাব্বায়িক, আমি এসেছি, বলে আত্মসমর্পণের মহড়া দেয়। ইহরামের নিয়্যত করে, কাফনের মত সিলাইবিহীন দু’টুকরা কাপড় পরে খালি পায়ে খালি মাথায় জীবিত অবস্থায়ই জাগতিক সকল কামনা বাসনা পরিত্যাগ করে নিজেকে দাফন করার জন্য প্রস্তুত হয় হাজী। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে আদেশ করেছেন, (অনুবাদ) “তোমরা মৃত্যুর আগেই মরে যাও।” এ নির্দেশের মহড়া দিতে প্রস্তুত হয়। কথায় ও কাজে চিন্তায় ও ধ্যানে আল্লাহ ছাড়া তার আর কোন চিন্তা নেই। তিনি সংসারে থেকেও সংসার ত্যাগী।
এ মহা প্রেরণা এক নবসমাজ ব্যবস্থার সংবিধান রচনায় সহায়ক হয়। বান্দা তখন হিংসা-বিদ্বেষ, মান-অভিমান ও জাগতিক সকল দুঃখ ব্যথা ভুলে গিয়ে ধনী-দারিদ্র এক কাতারে আল্লাহর ঘরের চারদিকে ঘুরে আত্মসমর্পণে উদ্বুদ্ধ হয়। এ মহড়া তাকে এক অপূর্ব আত্মচৈতন্যে উদ্বুদ্ধ করে। সে অকাতরে ধন বিতরণ করে। ধন তো বিতরণের জন্যই, দশজনের ভোগের জন্যই। ধনবানের একার ভোগের জন্য ধন সঞ্চিত হওয়া তো ইসলামের নীতি বিরুদ্ধ। হাজী আত্মত্যাগের মহিমায় বলীয়ান হয়ে, আরাফার ময়দানে বিশেষ দিনে অবস্থান করে মুৃজদালিফায় ও মীনায়, জামরায় পাথর মেরে, সাফআ মারওয়ায় দৌড়াদৌড়ি করে, কাবা ঘরে তাওয়াফ করে, আল্লাহর জিকিরে নিজেকে সমর্পিত চিত্তে, আল্লাহর ইচ্ছার কাছে বিলিয়ে দেয়। এদিক থেকে হজের রূহানী ফয়েজ ও ফযীলত অতুলনীয়।
প্রতি বছর দুনিয়ার বিভিন্ন স্থান থেকে লাখ লাখ মুসলিম মক্কা মোয়াযযামায় একত্রিত হয়ে আল্লাহর নির্দেশিত এই ফরয হুকুম পালন করে। সাম্য মৈত্রী, শৃংখলা আর ঐক্যবোধের চূড়ান্ত নিদর্শন এ হজ্ব। এ সম্মেলন বিশ্ব মুসলিমের ভ্রাতৃত্ব ও ভ্রাতৃত্ববোধ বিকাশের এক মোক্ষম সুযোগ। এ উপলক্ষে আরবী, আযমী, চীনি, জাপানী, ইউরোপীয় আমেরিকান, ইরানী, ইরাকী, মিসরী, সুদানী, পাকিস্তানী বাংলাদেশী, ভারতীয়, কাতারী, তুর্কী, নিগ্রো, সাইবেরিয়ান, মোঙ্গলস, নাইজরিয়ান ইত্যাদি বিভিন্ন ভাষাভাষী, বিভিন্ন সংস্কৃতির ধারক, বিভিন্ন বর্ণ সবাই ও জাতির লোক এক তাওহীদে বিশ্বাসী মুসলিম সাদা-কালো, ধনী-নির্ধনী উচু-নীচু মনিব-ভৃত্য নির্বিশেষে সবাই একই উদ্দেশ্যে একই স্থানে সমবেত হয়। সেখানে জাতিতে-জাতিতে, বর্ণে-বর্ণে, ভাষায়-ভাষায়, ইহরামের একই পোশাকে সজ্জিত হয়ে ক্ষুদ্র আত্মবোধের সব রকমের ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে উঠে যায় সবাই। একে অন্যের দেশ ভৌগোলিক সীমা, ইতিহাস, সংস্কৃতি, তাহজীব, রাষ্ট্র, সমাজ, শিক্ষা, অর্থনীতি সম্বন্ধে অবহিত হয়ে পরস্পর সমঝোতা ও সৌহার্দ্য সৃষ্টির সুযোগ পায়। ইসলামের তমুদ্দুন ও আদর্শকে দৃঢ় করার চাইতে বড় সুযোগ কোন রাষ্ট্র বা তন্ত্র কিংবা মতবাদ এ পর্যন্ত দিতে পারেনি। জাতিসংঘের বিভিন্ন দেশ ও বিভিন্ন জাতি যা প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে, হজ্বের মহামিলন সে সব উদ্দেশ্যকে সফল করে। অধিকন্তু মানবতার আধ্যাত্ম্য সংস্কারের অনুশীলনীর সুযোগ মিলে। একে অন্যের প্রতি অশ্রদ্ধা ঘৃণা-বিদ্বেষ, হিংসা-হানাহানি ও মতানৈক্য ভুলে গিয়ে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার সুযোগ পায়।
এ হজ্বেরই অন্যতম পালনীয় কর্তব্য কুরবানি। যে ত্যাগ ও সাধনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে হাজী তার নির্দিষ্ট পালনীয় কাজগুলো করেন, সে ত্যাগ ও সাধনাকে আরো সুষ্ঠু, সুন্দর, সার্থক করার উদ্দেশ্যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে এ কুরবানির। হাজী আরাফা থেকে ফিরে এসে মুজদালিফায় একরাত কাটিয়ে মিনায় আসেন। সেখানে তিন দিন অবস্থান কালে জামরায় পাথর মারতে হয় এবং পশু কুরবানি করতে হয়।
আর্থিক সঙ্গতি ও দৈহিক স্বাস্থ্যে সামর্থবান হলে জীবনে একবার হজ্ব করা ফযর। ফরয হওয়ামাত্র তা আদায় করতে হয়। কেননা, কাল কী হবে জানা নেই। আগামী বছর অর্থসঙ্গতি কিংবা স্বাস্থ্য এ কাজের অনুকূল নাও থাকতে পারে। আর কুরবানি, হজ্ব পালনকারীর জন্য তো বটেই, যার আর্থিক সঙ্গতি আছে, তিনি পৃথিবীর যেখানেই থাকুন কুরবানি অবশ্যই করবেন। হজ্ব জীবনে একবারমাত্র ফরয। কিন্তু কুরবানী জীবৎকালে যতদিন শরীয়তের বিধান অনুযায়ী সামর্থ্য থাকবে ততদিনে বছরে একবার জিলহজ্ব মাসের দশ তারিখ থেকে তের তারিখের মধ্যে কুরবানী আদায় করতে হবে।
কুরবানি মানে কেবল পশু কুরবানী নয়। সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার জন্য পাশব শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য এবং তার বিরুদ্ধে জয়লাভের জন্য অর্থহীন প্রদর্শনী নয়। বান্দা সর্বস্ব ত্যাগ করে একমাত্র রাব্বুল আলামীনের ইচ্ছায় আত্মসমর্পণ করে, আত্মবিলুপ্তির মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি করবে এ কুরবানীর দ্বারা। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বান্দাকে শিক্ষা দিয়েছেন যে, হে বান্দা তুমি বলো, “আমি একনিষ্ঠভাবে তার দিকে মুখ ফিরাচ্ছি, যিনি আকশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। আর আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই। বল আমার সালাত, আমার ইবাদত, আমার যৌবন ও আমার মরণ সবকিছুই প্রতিপালক আল্লাহর উদ্দেশ্যে । তার কোন শরীক নেই এবং আমি এরই জন্য আদিষ্ট হয়ছি। আর আমিই প্রথম মুসলিম।” আমার জীবন আমার কর্ম-ধর্ম, সুখ-দুঃখ, আমার লাভ-ক্ষতি, আমার জিহাদ, আমার ভোগ, ত্যাগ, আমার ইহকাল, পরকাল, আমার সংসার, সাধনা, জন্ম, মৃত্যু, এক কথায় আমার বস্তু-নির্বস্তু, সব ভাবনা-চিন্তা, আমার সব কিছুই বিশ্ব প্রতিপালক প্রভুর উদ্দেশ্যে নিবেদিত। তাঁরই থেকে এসেছি, তাঁরই কাছে সব পেয়েছি, আবার তাঁরই কাছে ফিরে যাব। আমার চাওয়া, আমার পাওয়া বলেতো কিছুই থাকতে পারে না। সবাই তো তারই উদ্দেশ্যে নিবেদিত। এ মহা শিক্ষাই হচ্ছে কুরবানীর পরম ও মৌল শিক্ষা।
কুরবানী বান্দাকে ত্যাগের মহিমায় উদ্বুদ্ধ করার এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত। এটি মুমিনকে স্বার্থ ত্যাগ করে পরার্থে আত্মসমর্পণ করার শিক্ষা দেয়।
কুরবানীতে যার আত্ম-কুরবানীর মহিমা প্রকাশিত হয় না, তার পশু হত্যায় আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই। আল্লাহ চান বান্দার অন্তর পবিত্র হোক, চিত্ত সংশোধিত হোক। সত্যের জন্যে, ন্যায়ের জন্য পরের কল্যাণের জন্য, সমাজের হিতের জন্যে নিজেকে সর্বোতভাবে সমর্পণ করে তার সন্তুষ্টি কামনা করাই প্রকৃত কুরবানী। কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তাআলা ফরমান (সারমর্ম) “আল্লাহর কাছে কুরবানীর পশু, গোশত ও তার রক্ত পৌঁছে না। বরং তার কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।” আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার এবং তাঁর আদেশ পালন করার ঐকান্তিকতা।
কুরবানী শব্দটি ‘র্কুব’ শব্দ থেকে গঠিত। এর অর্থ নৈকট্য। পার্থিব যা কিছু ভোগের সে সব কিছুই আল্লাহর কাছ থেকে পাওয়া। তাঁরই দান থেকে তারই উদ্দেশ্যে উজাড় করে দিয়ে আত্মশুদ্ধি করণই তাঁর নৈকট্য লাভের উপায়। তাঁর এ নৈকট্য লাভের সাধনার শিক্ষাই কুরবানীর তাৎপর্য, ঈদুল আযহার মৌল শিক্ষা।
কুরবানীর এ বিশেষ দিনটিতে হযরত ইবরাহীম খলীলুল্লাহ তাঁর প্রিয়তম বস্তু আপন সন্তানকে কুরবানী করেছিলেন। তিনি আদিষ্ট হয়েছিলেন হে ইবরাহীম! তোমার প্রিয়বস্তু আল্লাহর নামে কুরবানী করো। হযরত ইবরাহীম আ. বহু সংখ্যক বকরী কুরবনী করলেন। কিন্তু আবার আদেশ হলো- ইবরাহীম! তোমার প্রিয় বস্তু কুরবানী করো। তিনি ক্রমাগত বহুসংখ্যক উট, দুম্বা ও মেষ কুরবানী দিলেন। তারপরও সেই একই নির্দেশ। তিনি চিন্তিত হলেন। ভাবলেন, সত্যিই আমি তো আমার প্রিয়তম বস্তু একমাত্র পুত্রকে কুরবানী করার মাধ্যমে এ নির্দেশ কার্যকারী করতে পারি। তাহলে বোধ করি আমার রব খুশী হবেন। তিনি মনস্থির করে পুত্রকে সব কথা খুলে বললেন। কিশোর পুত্র ইসমাইলও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত হন। তিনি বললেন, “যে বিষয়ে আদিষ্ট হয়েছেন তা পালন করুন; আল্লাহর ইচ্ছায় আমাকে আপনি ধৈর্যশীলই পাবেন।” পিতা চোখ বেঁধে পুত্রকে কুরবানী করতে উদ্যত হলেন। গায়বী আওয়াজ হল, হে ইবরাহীম আমি তোমার ত্যাগে মুগ্ধ হয়েছি। তোমাকে পুত্র হত্যা করতে হবে না। আমি শুধু তোমার ইচ্ছার ঐকান্তিকতা ও সংকল্পের দৃঢ়তাই পরীক্ষা করছিলাম। আর তুমি সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছো। হযরত ইবরাহীম ও হযরত ইসমাইলের এ আত্মত্যাগের মহিমা স্মরণ করেই বিশ্ব মুসলিমের পশু কুরবানীর এ মহড়া।
মানুষ গৃহী হয়েও হবে সংসার বিরাগী। সংসার সরোবরে সাঁতার কেটেও রাজহাসের মত এক বিন্দু পানি তার পায়ে লাগবে না। এইতো প্রকৃত তাক্বওয়া। তাক্বওয়ার এক অর্থ সৎপথ গ্রহণ অসৎ পথ বর্জন, সত্য ন্যায়ের পথ গ্রহণ অসত্য ও অন্যায়ের পথ বর্জন। এ তাক্বওয়ার জন্যই মানবজীবনের সাধনা। কারণ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মুত্তাক্বীদের জন্যই হিদায়াত স্বরূপ আল কুরআন নামক জীবন বিধান পাঠিয়েছেন, পাঠিয়েছেন রাসূল। তাকওয়ার মাধ্যমে মুমিন হয় খাঁটি মুসলিম। আর প্রকৃত মুসলিমই হয় আল্লাহর গুণে গুণান্বিত আল্লাহর খলীফা পদে কৃত। মুমিন যদি কুরবানীর মাধ্যমে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলার জন্য আত্মবিসর্জন দিতে না পারল, তাহলে তার কুরবানী বৃথা। আল্লাহ আমাদের কুরবানী কবুল করুন! আমাদের কুরবানীর তাওফীক দান করুন! আমীন।
লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া সাঈদিয়া কারীমিয়া, ভাটারা-ঢাকা

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

ঈদুল আযহা , হজ্ব ও কুরবানী-মুফতী হুসাইন বিন জিয়া

আপডেট সময় : ০৪:৩১:২৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৫ জুন ২০২৩

ঈদ মানে খুশী, আনন্দ। ঈদ মানে যা ফিরে বারবার আসে। ১০ জিলহজ্ কুরবানীর দিন। আরবের কোন কোন এলাকায় বলে ‘ইয়াওমুন নাহার’, ‘ইয়াওমুল জব্হ’ জবাহ করার দিন। এ ঈদ মূলত হজের ঈদ। কুরবানীর বা বকরী ঈদ। ইসলামের পাঁচটি বুনিয়াদের অন্যতম একটি হলো হজ্ব। কালিমা, সালাত, সিয়াম এ তিনটি সব মুসলিম নর-নারীর জন্য ফরয। আর দুটি হজ্ব ও যাকাত ফরয কেবল সুস্থ ও সঙ্গতিসম্পন্নের জন্য। ঈমানের পরেই সালাত ও সিয়াম। এ দুটি মুমিনের ব্যক্তিগত ইবাদত। এতে তার দৈহিক ও আত্মিক অনুশীলনী, পরিচর্যা ও উৎকর্ষ সম্পৃক্ত।
আর যাকাত ও হজ্বের সাথে সম্পর্ক রয়েছে প্রধানত বান্দার দৈহিক ও আর্থিক পরিচর্যার। আর্থিক ও শারীরিক দিক থেকে সামর্থ বান্দার জন্য জীবনে একবার হজ্ব ফরয। আল্লাহু সুবনাহু তাআলা ইরশাদ করেছেন, (সারমর্ম) “আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে বাইতুল্লাহর হজ্ব সে লোকের ওপর ফরয, যার সে উদ্দেশ্যে পথ অতিক্রমের দৈহিক ও আর্থিক সামর্থ্য রয়েছে।” প্রত্যেক সুস্থ, সাবালক মুসলিম নর বা নারী, যার সফরে যাতায়াতের এবং যাবতীয় অনুষ্ঠান পালনের দৈহিক ও আর্থিক সক্ষমতা আছে এবং হজ থেকে ফিরে আসা পর্যন্ত তার উপর নির্ভরশীল পরিবারবর্গের আবশ্যকীয় ব্যয়ের নির্বাহের ব্যবস্থা রয়েছে, তারই জন্য হজ ফরয। মানুষ আশরাফ‚ল মাখলুকাত- সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ। তার স্বভাব ধর্মই হল পরস্পর-পরস্পরকে ভালোবাসা ও একে অন্যের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করা। কেবল তাই নয়। সৃষ্টির যাবতীয় প্রাণী ও অপ্রাণীর প্রতি তার স্নেহ মমতা ও দয়ার্দ্রতা প্রকাশও তার স্বভাব-ধর্ম। পরিবেশ-পরিমণ্ডল সুস্থ ও স্বাভাবিকতায় রক্ষা করার প্রবণতা তার অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য। অর্থাৎ সৃষ্টির ভারসাম্য রক্ষা করাই তার স্বভাব ধর্ম। এদিক থেকে তার এক সম্পর্ক তার মাবুদের সাথে আর এক সম্পর্ক তার সৃষ্ট বান্দার সাথে। আল্লাহর সাথে তার সম্পর্ককে বলা যায় তাঁর আবদিয়াত বা দাসত্বের সম্পর্ক। মানুষ আল্লাহর সৃষ্ট মাখলুক। তার বান্দা। সে সব সময় সকল অবস্থায় তাঁরই হুকুম পালন করবে, তাঁরই আনুগত্য করে যাবে। এটা মহান স্রষ্টা ও পালনকর্তার প্রতি তার দায়িত্ব ও কর্তব্য। আর বান্দা বা মাখলুকের সাথে তাঁর সম্পর্ককে বলা হয় খিলাফত। সে এ দুনিয়ায় আল্লাহর খলীফা। মাখলুককে সে একান্ত আপন মনে করে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে এর ভারসাম্য রক্ষা করবে। সকল সৃষ্টির প্রতি থাকবে তার সহানুভূতি। তাদের প্রয়োজনে, তাদের মঙ্গলের জন্য সে নিজেকে বিলিয়ে দিবে। অর্থাৎ আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজের মত মনে করে অপরকেও সমান আদরে লালন করবে। তবেই হবে তার খিলাফতের দায়িত্ব পালন।
ধর্ম সাধনার মূল উদ্দেশ্য হল সমগ্র ইচ্ছাশক্তির সাহায্যে মানবীয় অবাধ্য পশুপ্রবৃত্তি বা রিপুগুলোকে সংযত ও সংহত করে বিশ্বপালকের পরম কল্যাণময় ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ। এ ইচ্ছাশক্তিকেই দৃঢ় করার প্রথম সোপান কালিমা বা আল্লাহর একত্বে ও প্রভুত্বে বিশ্বাস স্থাপন করে তাঁরই ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁর প্রদর্শিত পথে নিজেকে পরিচালিত করাই পরবর্তী স্তরের সাধনায় যুুক্ত। বাহ্যিক অনুষ্ঠান সালাত বান্দাকে দুষ্কর্ম ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত রাখে। সিয়াম দেহ ও মনের ক্লেদ দূরীভূত করে। যাকাত সমাজ বিধানে অর্থনৈকি ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা, মানব কল্যাণ ও এর হিতে সহায়তা করে এবং স্বার্থ ত্যাগের মাধ্যমে আল্লাহর পথে নিজেকে বিসর্জন দেয়ার জন্য তৈরী করে। সব শেষে হজ্ব মুমিনের পূর্ণ সাধনার পরিপূর্ণ ইঙ্গিত বহন করে।
হজ্ব পালনকারী আল্লাহর উদ্দেশ্যে দুনিয়ার সব স্বার্থ ত্যাগ করে, সব মায়া কাটিয়ে আল্লাহরই সান্নিধ্যে গিয়ে লাব্বায়িক আল্লাহুম্মা লাব্বায়িক, আমি এসেছি, বলে আত্মসমর্পণের মহড়া দেয়। ইহরামের নিয়্যত করে, কাফনের মত সিলাইবিহীন দু’টুকরা কাপড় পরে খালি পায়ে খালি মাথায় জীবিত অবস্থায়ই জাগতিক সকল কামনা বাসনা পরিত্যাগ করে নিজেকে দাফন করার জন্য প্রস্তুত হয় হাজী। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে আদেশ করেছেন, (অনুবাদ) “তোমরা মৃত্যুর আগেই মরে যাও।” এ নির্দেশের মহড়া দিতে প্রস্তুত হয়। কথায় ও কাজে চিন্তায় ও ধ্যানে আল্লাহ ছাড়া তার আর কোন চিন্তা নেই। তিনি সংসারে থেকেও সংসার ত্যাগী।
এ মহা প্রেরণা এক নবসমাজ ব্যবস্থার সংবিধান রচনায় সহায়ক হয়। বান্দা তখন হিংসা-বিদ্বেষ, মান-অভিমান ও জাগতিক সকল দুঃখ ব্যথা ভুলে গিয়ে ধনী-দারিদ্র এক কাতারে আল্লাহর ঘরের চারদিকে ঘুরে আত্মসমর্পণে উদ্বুদ্ধ হয়। এ মহড়া তাকে এক অপূর্ব আত্মচৈতন্যে উদ্বুদ্ধ করে। সে অকাতরে ধন বিতরণ করে। ধন তো বিতরণের জন্যই, দশজনের ভোগের জন্যই। ধনবানের একার ভোগের জন্য ধন সঞ্চিত হওয়া তো ইসলামের নীতি বিরুদ্ধ। হাজী আত্মত্যাগের মহিমায় বলীয়ান হয়ে, আরাফার ময়দানে বিশেষ দিনে অবস্থান করে মুৃজদালিফায় ও মীনায়, জামরায় পাথর মেরে, সাফআ মারওয়ায় দৌড়াদৌড়ি করে, কাবা ঘরে তাওয়াফ করে, আল্লাহর জিকিরে নিজেকে সমর্পিত চিত্তে, আল্লাহর ইচ্ছার কাছে বিলিয়ে দেয়। এদিক থেকে হজের রূহানী ফয়েজ ও ফযীলত অতুলনীয়।
প্রতি বছর দুনিয়ার বিভিন্ন স্থান থেকে লাখ লাখ মুসলিম মক্কা মোয়াযযামায় একত্রিত হয়ে আল্লাহর নির্দেশিত এই ফরয হুকুম পালন করে। সাম্য মৈত্রী, শৃংখলা আর ঐক্যবোধের চূড়ান্ত নিদর্শন এ হজ্ব। এ সম্মেলন বিশ্ব মুসলিমের ভ্রাতৃত্ব ও ভ্রাতৃত্ববোধ বিকাশের এক মোক্ষম সুযোগ। এ উপলক্ষে আরবী, আযমী, চীনি, জাপানী, ইউরোপীয় আমেরিকান, ইরানী, ইরাকী, মিসরী, সুদানী, পাকিস্তানী বাংলাদেশী, ভারতীয়, কাতারী, তুর্কী, নিগ্রো, সাইবেরিয়ান, মোঙ্গলস, নাইজরিয়ান ইত্যাদি বিভিন্ন ভাষাভাষী, বিভিন্ন সংস্কৃতির ধারক, বিভিন্ন বর্ণ সবাই ও জাতির লোক এক তাওহীদে বিশ্বাসী মুসলিম সাদা-কালো, ধনী-নির্ধনী উচু-নীচু মনিব-ভৃত্য নির্বিশেষে সবাই একই উদ্দেশ্যে একই স্থানে সমবেত হয়। সেখানে জাতিতে-জাতিতে, বর্ণে-বর্ণে, ভাষায়-ভাষায়, ইহরামের একই পোশাকে সজ্জিত হয়ে ক্ষুদ্র আত্মবোধের সব রকমের ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে উঠে যায় সবাই। একে অন্যের দেশ ভৌগোলিক সীমা, ইতিহাস, সংস্কৃতি, তাহজীব, রাষ্ট্র, সমাজ, শিক্ষা, অর্থনীতি সম্বন্ধে অবহিত হয়ে পরস্পর সমঝোতা ও সৌহার্দ্য সৃষ্টির সুযোগ পায়। ইসলামের তমুদ্দুন ও আদর্শকে দৃঢ় করার চাইতে বড় সুযোগ কোন রাষ্ট্র বা তন্ত্র কিংবা মতবাদ এ পর্যন্ত দিতে পারেনি। জাতিসংঘের বিভিন্ন দেশ ও বিভিন্ন জাতি যা প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে, হজ্বের মহামিলন সে সব উদ্দেশ্যকে সফল করে। অধিকন্তু মানবতার আধ্যাত্ম্য সংস্কারের অনুশীলনীর সুযোগ মিলে। একে অন্যের প্রতি অশ্রদ্ধা ঘৃণা-বিদ্বেষ, হিংসা-হানাহানি ও মতানৈক্য ভুলে গিয়ে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার সুযোগ পায়।
এ হজ্বেরই অন্যতম পালনীয় কর্তব্য কুরবানি। যে ত্যাগ ও সাধনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে হাজী তার নির্দিষ্ট পালনীয় কাজগুলো করেন, সে ত্যাগ ও সাধনাকে আরো সুষ্ঠু, সুন্দর, সার্থক করার উদ্দেশ্যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে এ কুরবানির। হাজী আরাফা থেকে ফিরে এসে মুজদালিফায় একরাত কাটিয়ে মিনায় আসেন। সেখানে তিন দিন অবস্থান কালে জামরায় পাথর মারতে হয় এবং পশু কুরবানি করতে হয়।
আর্থিক সঙ্গতি ও দৈহিক স্বাস্থ্যে সামর্থবান হলে জীবনে একবার হজ্ব করা ফযর। ফরয হওয়ামাত্র তা আদায় করতে হয়। কেননা, কাল কী হবে জানা নেই। আগামী বছর অর্থসঙ্গতি কিংবা স্বাস্থ্য এ কাজের অনুকূল নাও থাকতে পারে। আর কুরবানি, হজ্ব পালনকারীর জন্য তো বটেই, যার আর্থিক সঙ্গতি আছে, তিনি পৃথিবীর যেখানেই থাকুন কুরবানি অবশ্যই করবেন। হজ্ব জীবনে একবারমাত্র ফরয। কিন্তু কুরবানী জীবৎকালে যতদিন শরীয়তের বিধান অনুযায়ী সামর্থ্য থাকবে ততদিনে বছরে একবার জিলহজ্ব মাসের দশ তারিখ থেকে তের তারিখের মধ্যে কুরবানী আদায় করতে হবে।
কুরবানি মানে কেবল পশু কুরবানী নয়। সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার জন্য পাশব শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য এবং তার বিরুদ্ধে জয়লাভের জন্য অর্থহীন প্রদর্শনী নয়। বান্দা সর্বস্ব ত্যাগ করে একমাত্র রাব্বুল আলামীনের ইচ্ছায় আত্মসমর্পণ করে, আত্মবিলুপ্তির মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি করবে এ কুরবানীর দ্বারা। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বান্দাকে শিক্ষা দিয়েছেন যে, হে বান্দা তুমি বলো, “আমি একনিষ্ঠভাবে তার দিকে মুখ ফিরাচ্ছি, যিনি আকশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। আর আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই। বল আমার সালাত, আমার ইবাদত, আমার যৌবন ও আমার মরণ সবকিছুই প্রতিপালক আল্লাহর উদ্দেশ্যে । তার কোন শরীক নেই এবং আমি এরই জন্য আদিষ্ট হয়ছি। আর আমিই প্রথম মুসলিম।” আমার জীবন আমার কর্ম-ধর্ম, সুখ-দুঃখ, আমার লাভ-ক্ষতি, আমার জিহাদ, আমার ভোগ, ত্যাগ, আমার ইহকাল, পরকাল, আমার সংসার, সাধনা, জন্ম, মৃত্যু, এক কথায় আমার বস্তু-নির্বস্তু, সব ভাবনা-চিন্তা, আমার সব কিছুই বিশ্ব প্রতিপালক প্রভুর উদ্দেশ্যে নিবেদিত। তাঁরই থেকে এসেছি, তাঁরই কাছে সব পেয়েছি, আবার তাঁরই কাছে ফিরে যাব। আমার চাওয়া, আমার পাওয়া বলেতো কিছুই থাকতে পারে না। সবাই তো তারই উদ্দেশ্যে নিবেদিত। এ মহা শিক্ষাই হচ্ছে কুরবানীর পরম ও মৌল শিক্ষা।
কুরবানী বান্দাকে ত্যাগের মহিমায় উদ্বুদ্ধ করার এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত। এটি মুমিনকে স্বার্থ ত্যাগ করে পরার্থে আত্মসমর্পণ করার শিক্ষা দেয়।
কুরবানীতে যার আত্ম-কুরবানীর মহিমা প্রকাশিত হয় না, তার পশু হত্যায় আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই। আল্লাহ চান বান্দার অন্তর পবিত্র হোক, চিত্ত সংশোধিত হোক। সত্যের জন্যে, ন্যায়ের জন্য পরের কল্যাণের জন্য, সমাজের হিতের জন্যে নিজেকে সর্বোতভাবে সমর্পণ করে তার সন্তুষ্টি কামনা করাই প্রকৃত কুরবানী। কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তাআলা ফরমান (সারমর্ম) “আল্লাহর কাছে কুরবানীর পশু, গোশত ও তার রক্ত পৌঁছে না। বরং তার কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।” আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার এবং তাঁর আদেশ পালন করার ঐকান্তিকতা।
কুরবানী শব্দটি ‘র্কুব’ শব্দ থেকে গঠিত। এর অর্থ নৈকট্য। পার্থিব যা কিছু ভোগের সে সব কিছুই আল্লাহর কাছ থেকে পাওয়া। তাঁরই দান থেকে তারই উদ্দেশ্যে উজাড় করে দিয়ে আত্মশুদ্ধি করণই তাঁর নৈকট্য লাভের উপায়। তাঁর এ নৈকট্য লাভের সাধনার শিক্ষাই কুরবানীর তাৎপর্য, ঈদুল আযহার মৌল শিক্ষা।
কুরবানীর এ বিশেষ দিনটিতে হযরত ইবরাহীম খলীলুল্লাহ তাঁর প্রিয়তম বস্তু আপন সন্তানকে কুরবানী করেছিলেন। তিনি আদিষ্ট হয়েছিলেন হে ইবরাহীম! তোমার প্রিয়বস্তু আল্লাহর নামে কুরবানী করো। হযরত ইবরাহীম আ. বহু সংখ্যক বকরী কুরবনী করলেন। কিন্তু আবার আদেশ হলো- ইবরাহীম! তোমার প্রিয় বস্তু কুরবানী করো। তিনি ক্রমাগত বহুসংখ্যক উট, দুম্বা ও মেষ কুরবানী দিলেন। তারপরও সেই একই নির্দেশ। তিনি চিন্তিত হলেন। ভাবলেন, সত্যিই আমি তো আমার প্রিয়তম বস্তু একমাত্র পুত্রকে কুরবানী করার মাধ্যমে এ নির্দেশ কার্যকারী করতে পারি। তাহলে বোধ করি আমার রব খুশী হবেন। তিনি মনস্থির করে পুত্রকে সব কথা খুলে বললেন। কিশোর পুত্র ইসমাইলও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত হন। তিনি বললেন, “যে বিষয়ে আদিষ্ট হয়েছেন তা পালন করুন; আল্লাহর ইচ্ছায় আমাকে আপনি ধৈর্যশীলই পাবেন।” পিতা চোখ বেঁধে পুত্রকে কুরবানী করতে উদ্যত হলেন। গায়বী আওয়াজ হল, হে ইবরাহীম আমি তোমার ত্যাগে মুগ্ধ হয়েছি। তোমাকে পুত্র হত্যা করতে হবে না। আমি শুধু তোমার ইচ্ছার ঐকান্তিকতা ও সংকল্পের দৃঢ়তাই পরীক্ষা করছিলাম। আর তুমি সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছো। হযরত ইবরাহীম ও হযরত ইসমাইলের এ আত্মত্যাগের মহিমা স্মরণ করেই বিশ্ব মুসলিমের পশু কুরবানীর এ মহড়া।
মানুষ গৃহী হয়েও হবে সংসার বিরাগী। সংসার সরোবরে সাঁতার কেটেও রাজহাসের মত এক বিন্দু পানি তার পায়ে লাগবে না। এইতো প্রকৃত তাক্বওয়া। তাক্বওয়ার এক অর্থ সৎপথ গ্রহণ অসৎ পথ বর্জন, সত্য ন্যায়ের পথ গ্রহণ অসত্য ও অন্যায়ের পথ বর্জন। এ তাক্বওয়ার জন্যই মানবজীবনের সাধনা। কারণ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মুত্তাক্বীদের জন্যই হিদায়াত স্বরূপ আল কুরআন নামক জীবন বিধান পাঠিয়েছেন, পাঠিয়েছেন রাসূল। তাকওয়ার মাধ্যমে মুমিন হয় খাঁটি মুসলিম। আর প্রকৃত মুসলিমই হয় আল্লাহর গুণে গুণান্বিত আল্লাহর খলীফা পদে কৃত। মুমিন যদি কুরবানীর মাধ্যমে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলার জন্য আত্মবিসর্জন দিতে না পারল, তাহলে তার কুরবানী বৃথা। আল্লাহ আমাদের কুরবানী কবুল করুন! আমাদের কুরবানীর তাওফীক দান করুন! আমীন।
লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া সাঈদিয়া কারীমিয়া, ভাটারা-ঢাকা