ইসলামের ইতিহাস
মুসলিমদের পরিচ্ছন্নতার ইতিহাস

- আপডেট সময় : ০২:০৯:৩৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৪ জুন ২০২৩ ৬৫ বার পড়া হয়েছে
মধ্যযুগের কথা বললে আমাদের অনেকের মাথায় যে শব্দগুলো চলে আসে তা হলো— অন্ধকার, দুর্গন্ধ, রুক্ষ এবং অপরিষ্কার। কিন্তু দশম শতাব্দীর ইসলামি বিশ্ব ছিল পুরোই ভিন্ন। তারা এতটাই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকত— তাদের বিভিন্ন পরিচ্ছন্নতা পদ্ধতি এবং হাম্মামখানায় (গোসলখানা) ব্যবহৃত সকল জিনিস বর্তমান যুগের পণ্যগুলোকে টেক্কা দিতে পারবে।
১৩ শতাব্দীতে আল-জাজারি নামক এক বিখ্যাত মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার তার লেখা ‘দ্য বুক অব নলেজ অব ইনজিনিয়াস মেকানিক্যাল ডিভাইসেস’ বইটিতে অজুর একটি স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের কথা উল্লেখ করেছিলেন। ময়ূরের মাথার মতো দেখতে এই যন্ত্রটিকে অতিথিদের সামনে নিয়ে যাওয়া হতো এবং অতিথিরা যন্ত্রটির মাথায় আলতোভাবে চাপ দিলেই এটির মুখ থেকে আটটি ছোট ছিদ্র দিয়ে পানি বের হতো। পানি নষ্ট না করে অজু করার জন্য যথেষ্ট পানি সরবরাহ করত এ যন্ত্রটি। কিছু কিছু যন্ত্রে একটা তোয়ালেও রাখা থাকত।
সেসময়ে মুসলিমরা তেল (প্রায় সময়ই অলিভ অয়েল) এবং আল-কালি (লবণের মতো একটি পদার্থ) মিশিয়ে সাবান বানাত। প্রাচীন পাণ্ডুলিপির বক্তব্য অনুসারে এই মিশ্রণটি আগুনের তাপে ফুটিয়ে সঠিক ঘনত্বে আনা হতো। এরপর এগুলোকে শক্ত হওয়ার জন্য রেখে দেওয়া হতো এবং এরপর হাম্মামে ব্যবহার করা হতো। প্রাচীন যুগের মুসলিমরা তাদের সৌন্দর্য নিয়েও ছিলেন বেশ সচেতন। আল-জাহরাবি নাম এক বিশেষজ্ঞ তার মেডিকেল বই ‘আত-তাসরিফ’-এ একটি অধ্যায়ে শুধুমাত্র কসমেটিক এবং রূপচর্চা নিয়ে আলোচনা করেছেন। এই অধ্যায়ের নাম ছিল— ‘দ্য মেডিসিনস অব বিউটি’।
আল্লাহ সুন্দর । সৌন্দর্যকে পছন্দ করেন তিনি । —মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। মুসলিম শরিফ, হাদিস নং-১৩১
বইটিতে আল-জাহরাবি ইসলামের সীমার ভেতর থেকে চুল এবং ত্বকের যত্ন, দাঁতের খেয়াল রাখা, মাড়ি শক্তপোক্ত করা নিয়েও আলোচনা করেছিলেন। তার সেই বইটিতে নাকের স্প্রে, মাউথওয়াশ, হাতের জন্য বিশেষ ক্রিম এবং সুগন্ধযুক্ত কাঠির ব্যবহার প্রসঙ্গও সংকলিত ছিল। এ ছাড়াও বইটিতে চুল কাটার জন্য যন্ত্র, চুল কালো করার রং এবং কোঁকড়ানো চুল সোজা করার জন্য একটি বিশেষ লোশন নিয়েও লেখা ছিল। হাজার বছর আগে লেখা সে বইটিতে সানট্যান লোশনের উপকারিতা নিয়েও কথা বলা হয়েছিল। কুফাতে (বর্তমানে ইরাক) জন্ম নেওয়া আল-কিন্দি সুগন্ধির ওপরে একটি বই লিখেছিলেন । ‘বুক অব দ্য কেমিস্ট্রি অব পারফিউম অ্যান্ড ডিস্টিলেশন’ নামক সেই বইটিতে বহু রকমের সুগন্ধির উপকরণ এবং দামি ওষুধের বিকল্পের কথা লেখা হয়েছিল। প্রথমে এগুলোকে সমাজের ধনী ব্যক্তিরা ব্যবহার করলেও ধীরে ধীরে সকলেই এগুলো ব্যবহার শুরু করে। এ ছাড়াও মুসলিম রসায়নবিদরা বহু উদ্ভিদ এবং ফুলের রস সংগ্রহ করে এগুলো দিয়ে সুগন্ধি এবং ভেষজ ওষুধ বানাতেন। মুসলিমদের এরকম উদ্ভাবন বণিক, পথিক এবং ধর্মযোদ্ধাদের দ্বারা পুরো ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। বিবিসির একটি প্রামাণ্যচিত্রে বলা হয়েছিল, প্রথমে ফ্রান্সের দক্ষিণে অবস্থিত হাউত প্রদেশে মুসলিমদের জ্ঞান বিস্তার হওয়া শুরু করে। এই প্রদেশে সুগন্ধি তৈরি করার জন্য উপযুক্ত জলবায়ু থাকার ফলে সেখানে গড়ে উঠেছিল বহু সুগন্ধি তৈরির কারখানা। ইসলামে আরেক গুরুত্বপূর্ণ প্রসাধনী হচ্ছে মেহেদি। হাতের ওপর অসাধারণ ডিজাইনের জন্য মেহেদি অত্যন্ত জনপ্রিয়। ইসলামের প্রসারের সাথে এই মেহেদিও পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং এটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সৌন্দর্যের উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হতো। সেসময়ে মহানবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) এবং তাঁর সঙ্গীরা মেহেদি দ্বারা তাদের দাড়ি রং করতেন, অন্যদিকে নারীরা হাত এবং পায়ের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতেন। আধুনিক কালের বিজ্ঞানীরা এটা প্রমাণ মেহেদির বহু ঔষধি গুণ রয়েছে। এই উদ্ভিদের পাতা এবং বীজেরও রয়েছে ঔষধি শরীরকে ঠাণ্ডা রাখতেও বেশ ভালো কাজ করে। এ ছাড়া মেহেদিতে রয়েছে বেশকিছু প্রাকৃতিক উপাদান— যা চুলের পুষ্টির জন্য অত্যন্ত কার্যকর। এটি ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধী ও রক্তক্ষরণ প্রতিরোধে সাহায্য করে। এই উপকারিতাগুলো এক হাজার বছর আগেকার মুসলিম সভ্যতা উপলব্ধি করেছিল এবং এগুলোকে পুরো ইউরোপে ছড়িয়ে দেওয়ায় আমরা বর্তমানেও এগুলোকে ব্যবহার করতে পারছি।
মুসলিম সভ্যতার ১০০১ আবিষ্কার বই থেকে…