০৭:৩৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১২ জুন ২০২৫, ২৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
ভোলা-বরিশাল সেতুর দাবিতে মানববন্ধন ভোলা জেলা ওলামা তলাবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বিলুপ্ত করায় বিমানবন্দরে এফবিসিসিএফএএ’র সংবাদ সম্মেলন ক্যারিয়ার বাংলাদেশের গোল টেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত দলিপাড়া ও দেশবাসীকে ঈদ-উল-ফিতরের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন আবু জাফর আলম উত্তরা ১১ নং সেক্টর ও দেশবাসীকে ঈদ-উল-ফিতরের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন অধ্যক্ষ সালাউদ্দিন ভূঁইয়া সেই গুলিবিদ্ধ ইমরান কে দেখতে গেলেন লুৎফুজ্জামান বাবর একাত্তরের ন্যায় ২৪ যোদ্ধারাও পাবে সকল সুবিধা-মুস্তাফিজ সেগুন গুম-খুনের শিকার ও চব্বিশের শহীদ পরিবারকে ঈদ উপহার দিলেন বিএনপি নেতা আমিনুল হক জাতিসঙ্ঘ শূন্য বর্জ্য দিবসে প্রফেসর ইউনূসকে অভিনন্দন জানালেন তুরস্কের ফার্স্ট লেডি চীনা বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার

কুরবানী : উদ্দেশ্য, গুরুত্ব ও বিধান

মোঃ মাছ্উদুর রহমান
  • আপডেট সময় : ১২:১৫:৪৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ৫ জুন ২০২৩ ৫১ বার পড়া হয়েছে
ভয়েস অব টাইম অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

মোঃ মাছউদুর রহমান*

স্বর্ণকে যত পোড়ানো হয়, স্বর্ণ তত খাঁটি হয়। শিক্ষার্থীর যত বেশী পরীক্ষা নেয়া হয়, লব্দ জ্ঞান তত মজবুত ও আত্মস্থ হয়। বান্দা থেকে যত পরীক্ষা নেয়া হয়, বান্দার ঈমান তত মজবুত হয়।  স্রষ্টার ইবাদতে ততবেশী নিমগ্ন হয়। একাগ্রচিত্তে সৃষ্টিকর্তার আনুগত্য লাভে ততবেশী মনোনিবেশ করে। আল্লাহ পাকের যে কোন হুকুমের সামনে গরদান ঝুঁকিয়ে দিতে দ্বিধাবোধ করে না। অন্তর তৈরী হয় একমাত্র আল্লাহর গুণে। আল্লাহ জাল্লাহ শানুহু তার প্রত্যেক নবী-রাসূলকে বিভিন্ন রকমের অসংখ্য-অগণিত পরীক্ষা দিয়ে ঈমান, ধৈর্য, তাক্বওয়া ও সহনশীলতার কষ্টি পাথরে ঘষে নবুয়তের দায়িত্ব পালনের উপযোগী করে তারপর মানব সমাজের সামনে উপস্থাপন করেছেন। কুরআনে কারীমে এরশাদ হচ্ছে,

وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ.

“আমি জ্বীন ও মানুষকে এ জন্য সৃষ্টি করেছি যে, তারা শুধু আমার ইবাদত করবে।” [সূরা আয্ যারিয়াত : ৫১ : ৫৬]

মহান আল্লাহ মানব জাতিকে একমাত্র তাঁর ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। তবে সেক্ষেত্রে তিনি কিছু ইবাদত ফরজ করেছেন, আর কিছুকে ওয়াজিব সাব্যস্ত করেছেন। মুসলিমগণের উচিত একনিষ্ঠভাবে একমাত্র তাঁর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে সেগুলো সম্পন্ন করা। কুরবানী সে ধরণের একটি ইবাদত; যার বিধান আদম আ. এর যুগ থেকেই চলে আসছে। ইসলামী শরীয়াতে এটি ইবাদত হিসেবে সিদ্ধ, যা কুরআর, হাদীস ও মুসলিম উম্মাহর ঐক্যমত দ্বারা প্রমাণিত। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের সঠিক ইতিহাস ও বিধানাবলী সম্পর্কে আমরা খুব কমই অবগত আছি। আলোচ্য নিবন্ধটি এ বিষয়ে আমাদের অনেক সহায়ক হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

আরবী ‘কুরবান’ শব্দটি ফারসী বা উর্দূতে ‘কুরবানী’ রূপে পরিচিত হয়েছে, যার অর্থ ‘নৈকট্য’। আর ‘কুরবান’ শব্দটি ‘কুরবাতুন’ শব্দ থেকে উৎপন্ন।  আরবী ‘কুরবাতুন’ এবং ‘কুরবান’ উভয় শব্দের শাব্দিক অর্থ নিকটবর্তী হওয়া, কারো নৈকট্য লাভ করা প্রভৃতি। ইসলামী পরিভাষায় ‘কুরবানী’ ঐ মাধ্যমকে বলা হয়, যার দ্বারা আল্লাহ রাববুল আলামীনের নৈকট্য অর্জন ও তার ইবাদতের জন্য পশু যবেহ করা হয়। (মাজদুদ্দীন ফীরোযাবাদী, আল-ক্বামূসুল মুহীত্ব, পৃ. ১৫৮; মুফরাদাত লি ইমাম রাগিব ৩/২৮৭; তাফসীরে কাশশাফ, ১/৩৩৩; বায়যাবী, ১/২২২)।

কুরআনুল কারীমে কুরবানী :

১. আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ – إِنَّ شَانِئَكَ هُوَ الْأَبْتَرُ.

“তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর ও পশু কুরবানী কর।” [সূরা কাওসার : ১০৮ : ২-৩]

২. আল্লাহ তা‘লা আরো বলেন,

قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ – لَا شَرِيكَ لَهُ وَبِذَلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُسْلِمِينَ.

“বল, আমার সালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহরই উদ্দেশ্যে। তার কোন শরিক নেই এবং আমি এর জন্য আদিষ্ট হয়েছি এবং আমিই প্রথম মুসলিম।” [সূরা আন‘আম : ৬ : ১৬২-১৬৩]

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে আদেশ যথাযথভাবে পালন করেছেন। সুতরাং তিনি ছিলেন অধিক সালাত ক্বায়েমকারী ও অধিক কুরবানীদাতা।

সুন্নাহ-এ কুরবানী :

مَنْ ذَبَحَ بَعْدَ الصَّلاَةِ فَقَدْ تَمَّ نُسُكُهُ، وَأَصَابَ سُنَّةَ الْمُسْلِمِينَ.

“বারা ইবনে আযিব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ঈদের সালাতের পর কুরবানীর পশু যবেহ করল তার কুরবানী পরিপূর্ণ হলো ও সে মুসলিমদের আদর্শ সঠিকভাবে পালন করল।” [বুখারী : ৫৫৪৫,  মুসলিম :  ১৯৬১]

قَالَ ضَحَّى النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم بِكَبْشَيْنِ أَمْلَحَيْنِ أَقْرَنَيْنِ ذَبَحَهُمَا بِيَدِهِ وَسَمَّى وَكَبَّرَ وَوَضَعَ رِجْلَهُ عَلَى صِفَاحِهِمَا ‏

“আনাস ইবনে মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ হতে দুটি সাদা-কালো বর্ণের দুম্বা কুরবানী করেছেন। তিনি বিসমিল্লাহ ও আল্লাহু আকবর বলেছেন। তিনি পা দিয়ে দুটো কাঁধের পাশ চেপে রাখেন।” [মুসলিম : ১৯৬৬, তিরমিযী : ১৪৯৪]

কুরবানীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস :

পৃথিবীর সর্বপ্রথম কুরবানী :

কুরবানীর ইতিহাস খুবই প্রাচীন। সেই আদি পিতা আদম আ. এর যুগ থেকেই কুরবানীর বিধান চলে আসছে। আদম আ. এর দুই ছেলে হাবীল ও কাবীলের কুরবানী পেশ করার কথা আমরা মহাগ্রন্থ আল-কুরআন থেকে জানতে পারি। মহান আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা বলেন,

وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ ابْنَيْ آدَمَ بِالْحَقِّ إِذْ قَرَّبَا قُرْبَانًا فَتُقُبِّلَ مِنْ أَحَدِهِمَا وَلَمْ يُتَقَبَّلْ مِنَ الْآخَرِ قَالَ لَأَقْتُلَنَّكَ قَالَ إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللَّهُ مِنَ الْمُتَّقِينَ.

“অর্থাৎ, আদমের দুই পুত্রের (হাবিল ও কাবিলের) বৃত্তান্ত তুমি তাদেরকে যথাযথভাবে শুনিয়ে দাও, যখন তারা উভয়ে কুরবানী করেছিল, তখন একজনের কুরবানী কবুল হলো এবং অন্যজনের কুরবানী কবুল হলো না। তাদের একজন বলল, ‘আমি তোমাকে অবশ্যই হত্যা করব। অপরজন বলল, ‘আল্লাহ তো সংযমীদের কুরবানীই কবূল করে থাকেন।” [সূরা মায়িদা : ৫ : ২৭]

কুরআনে বর্ণিত হাবীল ও কাবীল কর্তৃক সম্পাদিত কুরবানীর এ ঘটনা থেকেই মূলত কুরবানীর ইতিহাসের গোড়াপত্তন হয়েছে। এ ঘটনায় আমরা দেখতে পেলাম যে, কুরবানী দাতা ‘হাবীল’, যিনি মনের ঐকান্তিক আগ্রহ সহকারে আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের জন্যে একটি সুন্দর দুম্বা কুরবানী হিসেবে পেশ করেন। ফলে তার কুরবানী কবূল হয়। পক্ষান্তরে কাবীল, সে অমনোযোগী অবস্থায় কিছু খাদ্যশস্য কুরবানী হিসেবে পেশ করে। ফলে তার কুরবানী কবূল হয়নি। সুতরাং প্রমাণিত হলো কুরবানী মনের ঐকান্তিক আগ্রহ ছাড়া কবূল হয় না। তারপর  থেকে বিগত সকল উম্মতের উপরে এটা জারি ছিল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَلِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنْسَكًا لِيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَى مَا رَزَقَهُمْ مِنْ بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ فَإِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ فَلَهُ أَسْلِمُوا وَبَشِّرِ الْمُخْبِتِينَ.

“অর্থাৎ প্রত্যেক উম্মতের জন্য আমি কুরবানীর বিধান রেখেছিলাম, যাতে তারা উক্ত পশু যবেহ করার সময় আল্লাহর নাম স্মরণ করে এ জন্য যে, তিনি চতুষ্পদ জন্তু থেকে তাদের জন্য রিযিক নির্ধারণ করেছেন।” [সূরা হাজ্জ ২২ : ৩৪]

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা নাসাফী ও যামাখশারী বলেন, ‘আদম আ. থেকে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত প্রত্যেক জাতিকে আল্লাহ তা‘আলা তার নৈকট্য লাভের জন্য কুরবানীর বিধান দিয়েছেন। [তাফসীরে নাসাফী ৩/৭৯; কাশশাফ, ২/৩৩]

আদম আ. এর যুগে তারই পুত্র কাবীল ও হাবীলের কুরবানীর পর  থেকে ইবরাহীম আ. পর্যন্ত কুরবানী চলতে থাকে। প্রকৃতপক্ষে কুরবানীর ইতিহাস ততটা প্রাচীন, যতটা প্রাচীন দ্বীন-ধর্ম অথবা মানবজাতির ইতিহাস। মানবজাতির জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে যত শরীয়ত নাযিল হয়েছে, প্রত্যেক শরীয়তের মধ্যে কুরবানী করার বিধান জারি ছিল। প্রত্যেক উম্মতের ইবাদতের এ ছিল একটা অপরিহার্য অংশ।

কুরবানীর ফযীলত :

(ক) কুরবানী দাতা নবী ইব্রাহীম আ. ও মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদর্শ বাস্তবায়ন করে থাকেন।

(খ) পশুর রক্ত প্রবাহিত করার মাধ্যমে কুরবানী দাতা আল্লাহ রাববুল ‘আলামিনের নৈকট্য অর্জন করেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

لَنْ يَنَالَ اللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَاؤُهَا وَلَكِنْ يَنَالُهُ التَّقْوَى مِنْكُمْ كَذَلِكَ سَخَّرَهَا لَكُمْ لِتُكَبِّرُوا اللَّهَ عَلَى مَا هَدَاكُمْ وَبَشِّرِ الْمُحْسِنِينَ.

“আল্লাহর নিকট পৌছায় না উহার গোশত এবং রক্ত, বরং পৌঁছায় তোমাদের তাক্বওয়া। এ ভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর এজন্য যে, তিনি তোমাদের পথ-প্রদর্শন করেছেন; সুতরাং আপনি সুসংবাদ দিন সৎকর্মপরায়ণদেরকে।” [সূরা হজ্জ্ব : ২২ : ৩৭]

(গ) পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও অভাবীদের আনন্দ দান। আর এটা অন্য এক ধরণের আনন্দ যা কুরবানীর গোশতের পরিমাণ টাকা যদি আপনি তাদের সদকা দিতেন তাতে অর্জিত হত না। কুরবানী না করে তার পরিমাণ টাকা সদকা করে দিলে কুরবানী আদায় হবে না।

কুরবানীর গুরুত্ব :

কুরবানী হলো ইসলামের একটি শি’য়ার বা মহান নিদর্শন। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ দিয়েছেন,

فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ – إِنَّ شَانِئَكَ هُوَ الْأَبْتَرُ.

“তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর ও পশু কুরবানী কর।” [সূরা আল-কাউসার : ১০৮ : ২]

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

مَنْ كَانَ لَهُ سَعَةٌ وَلَمْ يُضَحِّ فَلاَ يَقْرَبَنَّ مُصَلاَّنَا.

“যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানি করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের কাছেও না আসে। [মুসনাদ আহমাদ, ইবন মাজাহ- ৩১২৩]

যারা কুরবানী পরিত্যাগ করে তাদের প্রতি এ হাদীস একটি সতর্কবাণী।

অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানী করার  নির্দেশ দিয়ে বলেন,

يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّ عَلَى كُلِّ أَهْلِ بَيْتٍ فِي كُلِّ عَامٍ أُضْحِيَّةً.

“হে লোক সকল, প্রত্যেক পরিবারের উপর কুরবানী দেয়া অপরিহার্য।” [সুনান ইবন মাজাহ-৩১২৫, আবু দাউদ : ২৭৮৮, তিরমিযী : ১৫১৮]

উল্লেখিত আয়াত ও হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, কুরবানী করা ওয়াজিব। তবে অনেক আলিম কুরবানী করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ বলেছেন।

কুরবানীর উদ্দেশ্য :

কুরবানী একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন শুধু তার ইবাদত করার জন্য। তাই আল্লাহ তা‘আলার বিধান তাঁর নির্দেশিত পথে পালন করতে হবে। তিনি বলেন,

وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ.

“আমি জ্বীন ও মানুষকে এ জন্য সৃষ্টি করেছি যে, তারা শুধু আমার ইবাদত করবে।” [সূরা আয্ যারিয়াত : ৫১ : ৫৬]

আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে কুরবানীর বিধান আমাদের উপর আসার বেশ কিছূ উদ্দেশ্যও রয়েছে,

১. শর্তহীন আনুগত্য :

আল্লাহ তা‘আলা তার বান্দাহকে যে কোনো আদেশ দেয়ার ইখতিয়ার রাখেন এবং বান্দাহ তা পালন করতে বাধ্য। তাই তার আনুগত্য হবে শর্তহীন। আল্লাহর আদেশ সহজ হোক আর কঠিন হোক তা পালন করার বিষয়ে একই মন-মানসিকতা থাকতে হবে এবং আল্লাহর হুকুম মানার বিষয়ে মায়া-মমতা প্রতিবন্ধক হতে পারে না। ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এর আনুগত্য ছিল শর্তহীন। এ জন্য মহান আল্লাহ যেভাবে বিশ্ব মানবম-লীকে বিভিন্ন জাতিতে বিভক্ত করেছেন, ঠিক সেভাবে সর্বশেষ জাতি হিসেবে মুসলিম জাতির পিতাও মনোনয়ন দিয়েছেন। কুরআনে এসেছে,

مِلَّةَ أَبِيكُمْ إِبْرَاهِيمَ هُوَ سَمَّاكُمُ الْمُسْلِمِينَ.

“এটা তোমাদের পিতা ইবরাহীমের মিল্লাত; তিনি পূর্বে তোমাদের নামকরণ করেছেন মুসলিম।” [সূরা হাজ্জ : ২২ : ৭৮]

২. তাকওয়া অর্জন ও আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করা :

তাকওয়া অর্জন ছাড়া আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায় না। একজন মুসলিমের অন্যতম চাওয়া হলো আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য অর্জন। পশুর রক্ত প্রবাহিত করার মাধ্যমে কুরবানী দাতা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নৈকট্য অর্জন করেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

لَنْ يَنَالَ اللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَاؤُهَا وَلَكِنْ يَنَالُهُ التَّقْوَى مِنْكُمْ كَذَلِكَ سَخَّرَهَا لَكُمْ لِتُكَبِّرُوا اللَّهَ عَلَى مَا هَدَاكُمْ وَبَشِّرِ الْمُحْسِنِينَ.

“আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না তাদের গোশত এবং রক্ত, বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া। এভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর এজন্য যে, তিনি তোমাদের পথ-প্রদর্শন করেছেন। সুতরাং আপনি সুসংবাদ দিন সৎকর্মপরায়ণদেরকে।” [সূরা হাজ্জ : ২২ : ৩৭]

প্রত্যেক ইবাদাতই আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ বহন করে। তাই কুরবানীর মাধ্যমে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করা হয়।

৩. ত্যাগের মহান পরীক্ষা :

কুরবানীর অন্যতম উদ্দেশ্য হলো ত্যাগের মানসিকতা তৈরী করা। আল্লাহর বিধান পালনে জান-মালের ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। কুরবানীর ঈদকে গোশত খাওয়ার অনুষ্ঠানে পরিণত করা নয়, বরং নিজেদের মধ্যকার পশুসুলভ আচরণ ত্যাগ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। নফসের আনুগত্য ত্যাগ করে আল্লাহর একান্ত অনুগত হওয়াই কুরবানীর উদ্দেশ্য।

وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَيْءٍ مِنَ الْخَوْفِ وَالْجُوعِ وَنَقْصٍ مِنَ الْأَمْوَالِ وَالْأَنْفُسِ وَالثَّمَرَاتِ وَبَشِّرِ الصَّابِرِينَ.

“আমি তোমাদেরকে অবশ্যই ভয়, দারিদ্র্য, সম্পদ ও জীবনের ক্ষয়ক্ষতির মাধ্যমে পরীক্ষা করবো।” [সূরা  আল বাকারা : ২ : ১৫৫]

কুরবানী বিশুদ্ধ হওয়ার শর্তাবলি :

কুরবানী করা আল্লাহর এক মহান ইবাদত। আর কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা এ কথা প্রমাণিত যে, কোন নেক আমল, সালেহ বা ভাল হয় না, কিংবা গৃহীত ও নৈকট্যশীল হয় না; যতক্ষণ না তাতে প্রাথমিকভাবে (যা অন্তরের সাথে সম্পৃক্ত) দু‘টি শর্ত পূরণ হয়েছে :

প্রথমত : ‘ইখলাস’, অর্থাৎ তা যেন খাটি আল্লাহরই উদ্দেশ্যে হয়। তা না হলে তা আল্লাহর নিকটে কবূল হবে না। যেমন কাবীলের নিকট থেকে কুরবানী কবুল করা হয়নি এবং তার কারণ স্বরূপ হাবীল বলেছিলেন।

إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللَّهُ مِنَ الْمُتَّقِينَ.

“অর্থাৎ ‘আল্লাহ তো মুত্তাক্বী (পরহেযগার ও সংযমী)দের কুরবানীই কবূল করে থাকেন। [সূরা মায়িদা ৫ : ২৭]

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ.

“আর তাদেরকে কেবল এই নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, তারা যেন আল্লাহর ‘ইবাদাত করে তাঁরই জন্য দ্বীনকে একনিষ্ঠ করে।” [সূরা বাই্যয়িনা : ৯৮ : ৫]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

اَخْلِصْ دِيْنَكَ يَكْفِيْكَ الْعَمَلُ الْقَلِيْلُ

“ ইখলাসের সাথে যদি অল্প আমলও করে, তাহলে সেটা নাজাতের জন্য যথেষ্ট হবে।” [আত্ তারগীব আন হাকেম]

এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন,

لَنْ يَنَالَ اللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَاؤُهَا وَلَكِنْ يَنَالُهُ التَّقْوَى مِنْكُمْ كَذَلِكَ سَخَّرَهَا لَكُمْ لِتُكَبِّرُوا اللَّهَ عَلَى مَا هَدَاكُمْ وَبَشِّرِ الْمُحْسِنِينَ.

“অর্থাৎ, ‘আল্লাহর কাছে ওগুলোর (কুরবানীর পশুর) না গোশত পৌঁছে, আর না রক্ত পৌঁছে বরং তার কাছে পৌঁছে তোমাদের তাক্বওয়া। এভাবে তিনি ওগুলোকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করতে পার এজন্য যে, তিনি তোমাদেরকে সঠিক পথ দেখিয়েছেন, কাজেই সৎকর্মশীলদেরকে তুমি সুসংবাদ দাও। [সূরা হাজ্জ ২২ : ৩৭]

দ্বিতীয়ত : তা যেন আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নির্দেশিত বিধি-বিধান অনুযায়ী হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

فَمَنْ كَانَ يَرْجُو لِقَاءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا وَلَا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا.

“অর্থাৎ, ‘যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের সাক্ষাৎ কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম করে এবং তার প্রতিপালকের ইবাদতে কাউকে শরীক না করে।” [সূরা কাহাফ : ১৮ : ১১০]

সুতরাং যারা কেবল বেশী করে গোশত খাওয়ার উদ্দেশ্যে কুরবানী দেয় অথবা লোক সমাজে নাম কুড়াবার উদ্দেশ্যে মোটা-তাজা অতিরিক্ত মূল্যের পশু ক্রয় করে এবং তা প্রদর্শন ও প্রচার করে থাকে তাদের কুরবানী যে ইবাদত নয়-তা বলাই বাহুল্য।

বাহ্যিকভাবে কুরবানী শুদ্ধ হওয়ার জন্য কিছু শর্ত রয়েছে :

(১) এমন পশু দ্বারা কুরবানী দিতে হবে যা শরীয়ত নির্ধারণ করে দিয়েছে। সেগুলো হলো উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা। এগুলোকে কুরআনের ভাষায় বলা হয় ‘বাহীমাতুল আন‘আম।’ যেমন এরশাদ হয়েছে-

وَلِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنْسَكًا لِيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَى مَا رَزَقَهُمْ مِنْ بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ.

“আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কুরবানীর নিয়ম করে দিয়েছি; তিনি তাদেরকে জীবনোপকরণ স্বরূপ যে সকল চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছেন, সেগুলোর উপর যেন তারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।” [সূরা হজ্জ্ব ২২ : ৩৪]

হাদীসে এসেছে,

وَعَنْ جَابِرٍ رضى الله عنه قَالَ: قَالَ رَسُولُ اَللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏”لَا تَذْبَحُوا إِلَّا مُسِنَّةً إِلَّا أَنْ يَعْسُرَ عَلَيْكُمْ فَتَذْبَحُوا جَذَعَةً مِنَ اَلضَّأْنِ

“তোমরা অবশ্যই নির্দিষ্ট বয়সের পশু কুরবানী করবে। তবে তা তোমাদের জন্য দুষ্কর হলে ছয় মাসের মেষ-শাবক কুরবানী করতে পার।” [মুসলিম : ১৯৬৩]

আর আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা ছাড়া অন্য জন্তু কুরবানী করেননি ও কুরবানী করতে বলেননি। তাই কুরবানী শুধু এগুলো দিয়েই করতে হবে। ইমাম মালিক রহ. এর মতে কুরবানীর জন্য সর্বোত্তম জন্তু হলো শিংওয়ালা সাদা-কালো দুম্বা। কারণ রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ধরণের দুম্বা কুরবানী করেছেন বলে সহীহ বুখারী ও মুসলিমের হাদীসে এসেছে। অধিকাংশ উলামাদের মতে, সবচেয়ে উৎকৃষ্ট কুরবানীর পশু হলো উট, অতঃপর গরু, তারপর মেষ (ভেড়া), তারপর ছাগল। আবার নর মেষ মাদী মেষ অপেক্ষা উত্তম। যেহেতু এ প্রসঙ্গে দলীল বর্ণিত হয়েছে। (আযওয়াউল বয়ান, ৫/৬৩৪)

একটি উট ও গরু-মহিষে সাত ব্যক্তি কুরবানীর জন্য শরীক হতে পারে। [মুসলিম : ১৩১৮] ইমাম শাওকানী বলেন, হজ্জের কুরবানীতে দশ এবং সাধারণ কুরবানীতে সাত ব্যক্তি শরীক হওয়াটাই সঠিক। (নায়লুল আওত্বার, ৮/১২৬)

ইমাম আবু হানিফার মতে শরিকানা কুরবানীতে সাত শরিকের অধিক হলে কারো কুরবানী বিশুদ্ধ হবে না।

যেমন হাদীসে এসেছে-

عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ قَالَ نَحَرْنَا مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم عَامَ الْحُدَيْبِيَةِ الْبَدَنَةَ عَنْ سَبْعَةٍ وَالْبَقَرَةَ عَنْ سَبْعَةٍ ‏.‏

“আমরা হুদাবিয়াতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে ছিলাম। তখন আমরা উট ও গরু দ্বারা সাত জনের পক্ষ থেকে কুরবানী দিয়েছি।” [মুসলিম : ১৩১৮, ইবনে মাজা : ৩১৩২]

কিন্তু মেষ বা ছাগলে ভাগাভাগি বৈধ নয়। তবে সওয়াবে একাধিক ব্যক্তিকে শরীক করা যাবে। সুতরাং একটি পরিবারের তরফ থেকে মাত্র একটি মেষ বা ছাগল যথেষ্ট হবে। তাতে সেই পরিবারের সদস্য সংখ্যা যতই হোক না কেন। গুণগত দিক দিয়ে উত্তম হলো কুরবানীর পশু হৃষ্টপুষ্ট, অধিক গোশত সম্পন্ন, নিখুঁত, দেখতে সুন্দর হওয়া।

(২) শরীয়তের দৃষ্টিতে কুরবানীর পশুর বয়সের দিকটা খেয়াল রাখা জরুরী। উট পাঁচ বছরের হতে হবে। গরু বা মহিষ দু‘বছরের হতে হবে। ছাগল, ভেড়া, দুম্বা হতে হবে এক বছর বয়সের। অবশ্য অসুবিধার ক্ষেত্রে ছয় মাস বয়সী মেষ কুরবানী করা যায়। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘দাতালো ছাড়া যবেহ করো না। তবে তা দুর্বল হলে ছয় মাসের মেষ যবেহ কর।’ [মুসলিম : ১৯৬৩]

(৩) কুরবানীর পশু যাবতীয় দোষ-ত্রুটি মুক্ত হতে হবে। যেমন হাদিসে এসেছে,

عَنْ الْبَرَاءَ بْنَ عَازِبٍ رضى الله عنه قَالَ: قَامَ فِينَا رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ ‏”‏ أَرْبَعٌ لاَ تَجُوزُ فِي الأَضَاحِي الْعَوْرَاءُ بَيِّنٌ عَوَرُهَا وَالْمَرِيضَةُ بَيِّنٌ مَرَضُهَا وَالْعَرْجَاءُ بَيِّنٌ ظَلْعُهَا وَالْكَسِيرُ الَّتِي لاَ تَنْقَى

সাহাবী বারা ইবনে আযেব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের মাঝে দাঁড়ালেন তারপর বললেন : চার ধরণের পশু, যা দিয়ে কুরবানী জায়েয হবে না। অন্ধ. যার অন্ধত্ব স্পষ্ট, রোগাক্রান্ত্র; যার রোগ স্পষ্ট, পঙ্গু; যার পগুত্ব স্পষ্ট এবং আহত; যার কোন অংগ ভেংগে গেছে। [আবূ দাউদ : ২৮০২]

অতএব এ চারের কোন এক ত্রুটিযুক্ত পশু দ্বারা কুরবানী সিদ্ধ হয় না। ইবনে কুদামাহ বলেন, “এ বিষয়ে কোন মতভেদ আছে কিনা তা আমরা জানি না।” [মুগনী, ১৩/৩৬৯]

কুরবানীর ওয়াক্ত বা সময় :

কুরবানী নির্দিষ্ট সময়ের সাথে সম্পর্কিত একটি ইবাদত। এ সময়ের পূর্বে যেমন কুরবানী আদায় হবে না তেমনি পরে করলেও আদায় হবে না। অবশ্য কাজা হিসেবে আদায় করলে অন্য কথা।

যারা ঈদের সালাত আদায় করবেন তাদের জন্য কুরবানীর সময় শুরু হবে ঈদের সালাত আদায় করার পর থেকে। যদি ঈদের সালাত আদায়ের পূর্বে কুরবানীর পশু যবেহ করা হয় তাহলে কুরবানী আদায় হবে না। যেমন হাদীসে এসেছে,

عَنِ الْبَرَاءِ بْنِ عَازِبٍ، قَالَ قَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم ‏”‏ إِنَّ أَوَّلَ مَا نَبْدَأُ فِي يَوْمِنَا هَذَا أَنْ نُصَلِّيَ، ثُمَّ نَرْجِعَ فَنَنْحَرَ، فَمَنْ فَعَلَ ذَلِكَ فَقَدْ أَصَابَ سُنَّتَنَا، وَمَنْ نَحَرَ قَبْلَ الصَّلاَةِ فَإِنَّمَا هُوَ لَحْمٌ قَدَّمَهُ لأَهْلِهِ، لَيْسَ مِنَ النُّسْكِ فِي شَىْءٍ.

“বারা ইবনে আযেব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি শুনেছি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুতবাতে বলেছেন, ‘এ দিনটি আমরা শুরু করব সালাত দিয়ে। অতঃপর সালাত থেকে ফিরে আমরা কুরবানী করব। যে এমন আমল করবে সে আমাদের আদর্শ সঠিকভাবে অনুসরণ করল। আর যে এর পূর্বে যবেহ করল সে তার পরিবারবর্গের জন্য গোশতের ব্যবস্থা করল। কুরবানীর কিছুই আদায় হলো না।” [বুখারী : ৯৬৫, ৫২২৬]

সালাত শেষ হওয়ার সাথে সাথে কুরবানীর পশু যবেহ না করে সালাতের খুতবা দু‘টি শেষ হওয়ার পর যবেহ করা ভাল। কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ রকম করেছেন। হাদীসে এসেছে,

عَنْ جُنْدَبٍ قَالَ صَلَّى النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم يَوْمَ النَّحْرِ ثُمَّ خَطَبَ، ثُمَّ ذَبَحَ.

“সাহাবী জুনদাব ইবনে সুফিয়ান আল-বাজালী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানীর দিন সালাত আদায় করলেন অতঃপর খুতবা দিলেন তারপর পশু যবেহ করলেন।” [বুখারী : ৯৮৫]

سَمِعْتُ جُنْدَبَ بْنَ سُفْيَانَ الْبَجَلِيَّ، قَالَ شَهِدْتُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم يَوْمَ النَّحْرِ فَقَالَ مَنْ ذَبَحَ قَبْلَ أَنْ يُصَلِّيَ فَلْيُعِدْ مَكَانَهَا أُخْرَى، وَمَنْ لَمْ يَذْبَحْ فَلْيَذْبَحْ. ‏

“জুনদাব ইবনে সুফিয়ান আরো বলেন, আমি কুরবানীর দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে ছিলাম। তিনি বলেন, যে ব্যক্তি সালাতের পূর্বে যবেহ করেছে সে যেন আবার অন্য স্থানে যবেহ করে। আর যে যবেহ করেনি সে যেন যবেহ করে।” [বুখারীর :  ৫৫৬২]

আর কুরবানীর সময় শেষ হবে যিলহজ্জ মাসের বারো তারিখের সূর্যাস্তের সাথে সাথে। অতএর কুরবানীর পশু যবেহ করার সময় হলো তিন দিন। যিলহজ্জ মাসের দশ, এগারো, বারো তারিখ। এটাই উলামায়ে কিরামের নিকট সর্বোত্তম মত হিসেবে প্রাধান্য পেয়েছে।

কুরবানী থেকে আমাদের শিক্ষা :

১.    ভোগ নয় ত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন।

২.    আল্লাহর সামনে নিঃশর্ত আনুগত্য প্রকাশ করা।

৩.    একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নৈকট্য অর্জন করার জন্য ইবাদত করা।

৪.    মহান প্রতিপালকের সাক্ষাতের জন্য সৎকর্ম করা।

৫.    প্রতিপালকের ইবাদতে কাউকে শরীক না করে।

৬.    কুরবানী মনের ঐকান্তিক আগ্রহ ছাড়া কবূল হয় না।

*সেক্রেটারী

সেন্টার ফর রিসার্চ এন্ড কমিউনিটি ডেভেলোপমেন্ট

 

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

কুরবানী : উদ্দেশ্য, গুরুত্ব ও বিধান

আপডেট সময় : ১২:১৫:৪৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ৫ জুন ২০২৩

মোঃ মাছউদুর রহমান*

স্বর্ণকে যত পোড়ানো হয়, স্বর্ণ তত খাঁটি হয়। শিক্ষার্থীর যত বেশী পরীক্ষা নেয়া হয়, লব্দ জ্ঞান তত মজবুত ও আত্মস্থ হয়। বান্দা থেকে যত পরীক্ষা নেয়া হয়, বান্দার ঈমান তত মজবুত হয়।  স্রষ্টার ইবাদতে ততবেশী নিমগ্ন হয়। একাগ্রচিত্তে সৃষ্টিকর্তার আনুগত্য লাভে ততবেশী মনোনিবেশ করে। আল্লাহ পাকের যে কোন হুকুমের সামনে গরদান ঝুঁকিয়ে দিতে দ্বিধাবোধ করে না। অন্তর তৈরী হয় একমাত্র আল্লাহর গুণে। আল্লাহ জাল্লাহ শানুহু তার প্রত্যেক নবী-রাসূলকে বিভিন্ন রকমের অসংখ্য-অগণিত পরীক্ষা দিয়ে ঈমান, ধৈর্য, তাক্বওয়া ও সহনশীলতার কষ্টি পাথরে ঘষে নবুয়তের দায়িত্ব পালনের উপযোগী করে তারপর মানব সমাজের সামনে উপস্থাপন করেছেন। কুরআনে কারীমে এরশাদ হচ্ছে,

وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ.

“আমি জ্বীন ও মানুষকে এ জন্য সৃষ্টি করেছি যে, তারা শুধু আমার ইবাদত করবে।” [সূরা আয্ যারিয়াত : ৫১ : ৫৬]

মহান আল্লাহ মানব জাতিকে একমাত্র তাঁর ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। তবে সেক্ষেত্রে তিনি কিছু ইবাদত ফরজ করেছেন, আর কিছুকে ওয়াজিব সাব্যস্ত করেছেন। মুসলিমগণের উচিত একনিষ্ঠভাবে একমাত্র তাঁর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে সেগুলো সম্পন্ন করা। কুরবানী সে ধরণের একটি ইবাদত; যার বিধান আদম আ. এর যুগ থেকেই চলে আসছে। ইসলামী শরীয়াতে এটি ইবাদত হিসেবে সিদ্ধ, যা কুরআর, হাদীস ও মুসলিম উম্মাহর ঐক্যমত দ্বারা প্রমাণিত। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের সঠিক ইতিহাস ও বিধানাবলী সম্পর্কে আমরা খুব কমই অবগত আছি। আলোচ্য নিবন্ধটি এ বিষয়ে আমাদের অনেক সহায়ক হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

আরবী ‘কুরবান’ শব্দটি ফারসী বা উর্দূতে ‘কুরবানী’ রূপে পরিচিত হয়েছে, যার অর্থ ‘নৈকট্য’। আর ‘কুরবান’ শব্দটি ‘কুরবাতুন’ শব্দ থেকে উৎপন্ন।  আরবী ‘কুরবাতুন’ এবং ‘কুরবান’ উভয় শব্দের শাব্দিক অর্থ নিকটবর্তী হওয়া, কারো নৈকট্য লাভ করা প্রভৃতি। ইসলামী পরিভাষায় ‘কুরবানী’ ঐ মাধ্যমকে বলা হয়, যার দ্বারা আল্লাহ রাববুল আলামীনের নৈকট্য অর্জন ও তার ইবাদতের জন্য পশু যবেহ করা হয়। (মাজদুদ্দীন ফীরোযাবাদী, আল-ক্বামূসুল মুহীত্ব, পৃ. ১৫৮; মুফরাদাত লি ইমাম রাগিব ৩/২৮৭; তাফসীরে কাশশাফ, ১/৩৩৩; বায়যাবী, ১/২২২)।

কুরআনুল কারীমে কুরবানী :

১. আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ – إِنَّ شَانِئَكَ هُوَ الْأَبْتَرُ.

“তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর ও পশু কুরবানী কর।” [সূরা কাওসার : ১০৮ : ২-৩]

২. আল্লাহ তা‘লা আরো বলেন,

قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ – لَا شَرِيكَ لَهُ وَبِذَلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُسْلِمِينَ.

“বল, আমার সালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহরই উদ্দেশ্যে। তার কোন শরিক নেই এবং আমি এর জন্য আদিষ্ট হয়েছি এবং আমিই প্রথম মুসলিম।” [সূরা আন‘আম : ৬ : ১৬২-১৬৩]

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে আদেশ যথাযথভাবে পালন করেছেন। সুতরাং তিনি ছিলেন অধিক সালাত ক্বায়েমকারী ও অধিক কুরবানীদাতা।

সুন্নাহ-এ কুরবানী :

مَنْ ذَبَحَ بَعْدَ الصَّلاَةِ فَقَدْ تَمَّ نُسُكُهُ، وَأَصَابَ سُنَّةَ الْمُسْلِمِينَ.

“বারা ইবনে আযিব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ঈদের সালাতের পর কুরবানীর পশু যবেহ করল তার কুরবানী পরিপূর্ণ হলো ও সে মুসলিমদের আদর্শ সঠিকভাবে পালন করল।” [বুখারী : ৫৫৪৫,  মুসলিম :  ১৯৬১]

قَالَ ضَحَّى النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم بِكَبْشَيْنِ أَمْلَحَيْنِ أَقْرَنَيْنِ ذَبَحَهُمَا بِيَدِهِ وَسَمَّى وَكَبَّرَ وَوَضَعَ رِجْلَهُ عَلَى صِفَاحِهِمَا ‏

“আনাস ইবনে মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ হতে দুটি সাদা-কালো বর্ণের দুম্বা কুরবানী করেছেন। তিনি বিসমিল্লাহ ও আল্লাহু আকবর বলেছেন। তিনি পা দিয়ে দুটো কাঁধের পাশ চেপে রাখেন।” [মুসলিম : ১৯৬৬, তিরমিযী : ১৪৯৪]

কুরবানীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস :

পৃথিবীর সর্বপ্রথম কুরবানী :

কুরবানীর ইতিহাস খুবই প্রাচীন। সেই আদি পিতা আদম আ. এর যুগ থেকেই কুরবানীর বিধান চলে আসছে। আদম আ. এর দুই ছেলে হাবীল ও কাবীলের কুরবানী পেশ করার কথা আমরা মহাগ্রন্থ আল-কুরআন থেকে জানতে পারি। মহান আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা বলেন,

وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ ابْنَيْ آدَمَ بِالْحَقِّ إِذْ قَرَّبَا قُرْبَانًا فَتُقُبِّلَ مِنْ أَحَدِهِمَا وَلَمْ يُتَقَبَّلْ مِنَ الْآخَرِ قَالَ لَأَقْتُلَنَّكَ قَالَ إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللَّهُ مِنَ الْمُتَّقِينَ.

“অর্থাৎ, আদমের দুই পুত্রের (হাবিল ও কাবিলের) বৃত্তান্ত তুমি তাদেরকে যথাযথভাবে শুনিয়ে দাও, যখন তারা উভয়ে কুরবানী করেছিল, তখন একজনের কুরবানী কবুল হলো এবং অন্যজনের কুরবানী কবুল হলো না। তাদের একজন বলল, ‘আমি তোমাকে অবশ্যই হত্যা করব। অপরজন বলল, ‘আল্লাহ তো সংযমীদের কুরবানীই কবূল করে থাকেন।” [সূরা মায়িদা : ৫ : ২৭]

কুরআনে বর্ণিত হাবীল ও কাবীল কর্তৃক সম্পাদিত কুরবানীর এ ঘটনা থেকেই মূলত কুরবানীর ইতিহাসের গোড়াপত্তন হয়েছে। এ ঘটনায় আমরা দেখতে পেলাম যে, কুরবানী দাতা ‘হাবীল’, যিনি মনের ঐকান্তিক আগ্রহ সহকারে আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের জন্যে একটি সুন্দর দুম্বা কুরবানী হিসেবে পেশ করেন। ফলে তার কুরবানী কবূল হয়। পক্ষান্তরে কাবীল, সে অমনোযোগী অবস্থায় কিছু খাদ্যশস্য কুরবানী হিসেবে পেশ করে। ফলে তার কুরবানী কবূল হয়নি। সুতরাং প্রমাণিত হলো কুরবানী মনের ঐকান্তিক আগ্রহ ছাড়া কবূল হয় না। তারপর  থেকে বিগত সকল উম্মতের উপরে এটা জারি ছিল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَلِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنْسَكًا لِيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَى مَا رَزَقَهُمْ مِنْ بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ فَإِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ فَلَهُ أَسْلِمُوا وَبَشِّرِ الْمُخْبِتِينَ.

“অর্থাৎ প্রত্যেক উম্মতের জন্য আমি কুরবানীর বিধান রেখেছিলাম, যাতে তারা উক্ত পশু যবেহ করার সময় আল্লাহর নাম স্মরণ করে এ জন্য যে, তিনি চতুষ্পদ জন্তু থেকে তাদের জন্য রিযিক নির্ধারণ করেছেন।” [সূরা হাজ্জ ২২ : ৩৪]

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা নাসাফী ও যামাখশারী বলেন, ‘আদম আ. থেকে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত প্রত্যেক জাতিকে আল্লাহ তা‘আলা তার নৈকট্য লাভের জন্য কুরবানীর বিধান দিয়েছেন। [তাফসীরে নাসাফী ৩/৭৯; কাশশাফ, ২/৩৩]

আদম আ. এর যুগে তারই পুত্র কাবীল ও হাবীলের কুরবানীর পর  থেকে ইবরাহীম আ. পর্যন্ত কুরবানী চলতে থাকে। প্রকৃতপক্ষে কুরবানীর ইতিহাস ততটা প্রাচীন, যতটা প্রাচীন দ্বীন-ধর্ম অথবা মানবজাতির ইতিহাস। মানবজাতির জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে যত শরীয়ত নাযিল হয়েছে, প্রত্যেক শরীয়তের মধ্যে কুরবানী করার বিধান জারি ছিল। প্রত্যেক উম্মতের ইবাদতের এ ছিল একটা অপরিহার্য অংশ।

কুরবানীর ফযীলত :

(ক) কুরবানী দাতা নবী ইব্রাহীম আ. ও মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদর্শ বাস্তবায়ন করে থাকেন।

(খ) পশুর রক্ত প্রবাহিত করার মাধ্যমে কুরবানী দাতা আল্লাহ রাববুল ‘আলামিনের নৈকট্য অর্জন করেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

لَنْ يَنَالَ اللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَاؤُهَا وَلَكِنْ يَنَالُهُ التَّقْوَى مِنْكُمْ كَذَلِكَ سَخَّرَهَا لَكُمْ لِتُكَبِّرُوا اللَّهَ عَلَى مَا هَدَاكُمْ وَبَشِّرِ الْمُحْسِنِينَ.

“আল্লাহর নিকট পৌছায় না উহার গোশত এবং রক্ত, বরং পৌঁছায় তোমাদের তাক্বওয়া। এ ভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর এজন্য যে, তিনি তোমাদের পথ-প্রদর্শন করেছেন; সুতরাং আপনি সুসংবাদ দিন সৎকর্মপরায়ণদেরকে।” [সূরা হজ্জ্ব : ২২ : ৩৭]

(গ) পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও অভাবীদের আনন্দ দান। আর এটা অন্য এক ধরণের আনন্দ যা কুরবানীর গোশতের পরিমাণ টাকা যদি আপনি তাদের সদকা দিতেন তাতে অর্জিত হত না। কুরবানী না করে তার পরিমাণ টাকা সদকা করে দিলে কুরবানী আদায় হবে না।

কুরবানীর গুরুত্ব :

কুরবানী হলো ইসলামের একটি শি’য়ার বা মহান নিদর্শন। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ দিয়েছেন,

فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ – إِنَّ شَانِئَكَ هُوَ الْأَبْتَرُ.

“তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর ও পশু কুরবানী কর।” [সূরা আল-কাউসার : ১০৮ : ২]

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

مَنْ كَانَ لَهُ سَعَةٌ وَلَمْ يُضَحِّ فَلاَ يَقْرَبَنَّ مُصَلاَّنَا.

“যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানি করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের কাছেও না আসে। [মুসনাদ আহমাদ, ইবন মাজাহ- ৩১২৩]

যারা কুরবানী পরিত্যাগ করে তাদের প্রতি এ হাদীস একটি সতর্কবাণী।

অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানী করার  নির্দেশ দিয়ে বলেন,

يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّ عَلَى كُلِّ أَهْلِ بَيْتٍ فِي كُلِّ عَامٍ أُضْحِيَّةً.

“হে লোক সকল, প্রত্যেক পরিবারের উপর কুরবানী দেয়া অপরিহার্য।” [সুনান ইবন মাজাহ-৩১২৫, আবু দাউদ : ২৭৮৮, তিরমিযী : ১৫১৮]

উল্লেখিত আয়াত ও হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, কুরবানী করা ওয়াজিব। তবে অনেক আলিম কুরবানী করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ বলেছেন।

কুরবানীর উদ্দেশ্য :

কুরবানী একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন শুধু তার ইবাদত করার জন্য। তাই আল্লাহ তা‘আলার বিধান তাঁর নির্দেশিত পথে পালন করতে হবে। তিনি বলেন,

وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ.

“আমি জ্বীন ও মানুষকে এ জন্য সৃষ্টি করেছি যে, তারা শুধু আমার ইবাদত করবে।” [সূরা আয্ যারিয়াত : ৫১ : ৫৬]

আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে কুরবানীর বিধান আমাদের উপর আসার বেশ কিছূ উদ্দেশ্যও রয়েছে,

১. শর্তহীন আনুগত্য :

আল্লাহ তা‘আলা তার বান্দাহকে যে কোনো আদেশ দেয়ার ইখতিয়ার রাখেন এবং বান্দাহ তা পালন করতে বাধ্য। তাই তার আনুগত্য হবে শর্তহীন। আল্লাহর আদেশ সহজ হোক আর কঠিন হোক তা পালন করার বিষয়ে একই মন-মানসিকতা থাকতে হবে এবং আল্লাহর হুকুম মানার বিষয়ে মায়া-মমতা প্রতিবন্ধক হতে পারে না। ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এর আনুগত্য ছিল শর্তহীন। এ জন্য মহান আল্লাহ যেভাবে বিশ্ব মানবম-লীকে বিভিন্ন জাতিতে বিভক্ত করেছেন, ঠিক সেভাবে সর্বশেষ জাতি হিসেবে মুসলিম জাতির পিতাও মনোনয়ন দিয়েছেন। কুরআনে এসেছে,

مِلَّةَ أَبِيكُمْ إِبْرَاهِيمَ هُوَ سَمَّاكُمُ الْمُسْلِمِينَ.

“এটা তোমাদের পিতা ইবরাহীমের মিল্লাত; তিনি পূর্বে তোমাদের নামকরণ করেছেন মুসলিম।” [সূরা হাজ্জ : ২২ : ৭৮]

২. তাকওয়া অর্জন ও আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করা :

তাকওয়া অর্জন ছাড়া আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায় না। একজন মুসলিমের অন্যতম চাওয়া হলো আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য অর্জন। পশুর রক্ত প্রবাহিত করার মাধ্যমে কুরবানী দাতা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নৈকট্য অর্জন করেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

لَنْ يَنَالَ اللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَاؤُهَا وَلَكِنْ يَنَالُهُ التَّقْوَى مِنْكُمْ كَذَلِكَ سَخَّرَهَا لَكُمْ لِتُكَبِّرُوا اللَّهَ عَلَى مَا هَدَاكُمْ وَبَشِّرِ الْمُحْسِنِينَ.

“আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না তাদের গোশত এবং রক্ত, বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া। এভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর এজন্য যে, তিনি তোমাদের পথ-প্রদর্শন করেছেন। সুতরাং আপনি সুসংবাদ দিন সৎকর্মপরায়ণদেরকে।” [সূরা হাজ্জ : ২২ : ৩৭]

প্রত্যেক ইবাদাতই আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ বহন করে। তাই কুরবানীর মাধ্যমে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করা হয়।

৩. ত্যাগের মহান পরীক্ষা :

কুরবানীর অন্যতম উদ্দেশ্য হলো ত্যাগের মানসিকতা তৈরী করা। আল্লাহর বিধান পালনে জান-মালের ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। কুরবানীর ঈদকে গোশত খাওয়ার অনুষ্ঠানে পরিণত করা নয়, বরং নিজেদের মধ্যকার পশুসুলভ আচরণ ত্যাগ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। নফসের আনুগত্য ত্যাগ করে আল্লাহর একান্ত অনুগত হওয়াই কুরবানীর উদ্দেশ্য।

وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَيْءٍ مِنَ الْخَوْفِ وَالْجُوعِ وَنَقْصٍ مِنَ الْأَمْوَالِ وَالْأَنْفُسِ وَالثَّمَرَاتِ وَبَشِّرِ الصَّابِرِينَ.

“আমি তোমাদেরকে অবশ্যই ভয়, দারিদ্র্য, সম্পদ ও জীবনের ক্ষয়ক্ষতির মাধ্যমে পরীক্ষা করবো।” [সূরা  আল বাকারা : ২ : ১৫৫]

কুরবানী বিশুদ্ধ হওয়ার শর্তাবলি :

কুরবানী করা আল্লাহর এক মহান ইবাদত। আর কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা এ কথা প্রমাণিত যে, কোন নেক আমল, সালেহ বা ভাল হয় না, কিংবা গৃহীত ও নৈকট্যশীল হয় না; যতক্ষণ না তাতে প্রাথমিকভাবে (যা অন্তরের সাথে সম্পৃক্ত) দু‘টি শর্ত পূরণ হয়েছে :

প্রথমত : ‘ইখলাস’, অর্থাৎ তা যেন খাটি আল্লাহরই উদ্দেশ্যে হয়। তা না হলে তা আল্লাহর নিকটে কবূল হবে না। যেমন কাবীলের নিকট থেকে কুরবানী কবুল করা হয়নি এবং তার কারণ স্বরূপ হাবীল বলেছিলেন।

إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللَّهُ مِنَ الْمُتَّقِينَ.

“অর্থাৎ ‘আল্লাহ তো মুত্তাক্বী (পরহেযগার ও সংযমী)দের কুরবানীই কবূল করে থাকেন। [সূরা মায়িদা ৫ : ২৭]

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ.

“আর তাদেরকে কেবল এই নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, তারা যেন আল্লাহর ‘ইবাদাত করে তাঁরই জন্য দ্বীনকে একনিষ্ঠ করে।” [সূরা বাই্যয়িনা : ৯৮ : ৫]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

اَخْلِصْ دِيْنَكَ يَكْفِيْكَ الْعَمَلُ الْقَلِيْلُ

“ ইখলাসের সাথে যদি অল্প আমলও করে, তাহলে সেটা নাজাতের জন্য যথেষ্ট হবে।” [আত্ তারগীব আন হাকেম]

এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন,

لَنْ يَنَالَ اللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَاؤُهَا وَلَكِنْ يَنَالُهُ التَّقْوَى مِنْكُمْ كَذَلِكَ سَخَّرَهَا لَكُمْ لِتُكَبِّرُوا اللَّهَ عَلَى مَا هَدَاكُمْ وَبَشِّرِ الْمُحْسِنِينَ.

“অর্থাৎ, ‘আল্লাহর কাছে ওগুলোর (কুরবানীর পশুর) না গোশত পৌঁছে, আর না রক্ত পৌঁছে বরং তার কাছে পৌঁছে তোমাদের তাক্বওয়া। এভাবে তিনি ওগুলোকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করতে পার এজন্য যে, তিনি তোমাদেরকে সঠিক পথ দেখিয়েছেন, কাজেই সৎকর্মশীলদেরকে তুমি সুসংবাদ দাও। [সূরা হাজ্জ ২২ : ৩৭]

দ্বিতীয়ত : তা যেন আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নির্দেশিত বিধি-বিধান অনুযায়ী হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

فَمَنْ كَانَ يَرْجُو لِقَاءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا وَلَا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا.

“অর্থাৎ, ‘যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের সাক্ষাৎ কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম করে এবং তার প্রতিপালকের ইবাদতে কাউকে শরীক না করে।” [সূরা কাহাফ : ১৮ : ১১০]

সুতরাং যারা কেবল বেশী করে গোশত খাওয়ার উদ্দেশ্যে কুরবানী দেয় অথবা লোক সমাজে নাম কুড়াবার উদ্দেশ্যে মোটা-তাজা অতিরিক্ত মূল্যের পশু ক্রয় করে এবং তা প্রদর্শন ও প্রচার করে থাকে তাদের কুরবানী যে ইবাদত নয়-তা বলাই বাহুল্য।

বাহ্যিকভাবে কুরবানী শুদ্ধ হওয়ার জন্য কিছু শর্ত রয়েছে :

(১) এমন পশু দ্বারা কুরবানী দিতে হবে যা শরীয়ত নির্ধারণ করে দিয়েছে। সেগুলো হলো উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা। এগুলোকে কুরআনের ভাষায় বলা হয় ‘বাহীমাতুল আন‘আম।’ যেমন এরশাদ হয়েছে-

وَلِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنْسَكًا لِيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَى مَا رَزَقَهُمْ مِنْ بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ.

“আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কুরবানীর নিয়ম করে দিয়েছি; তিনি তাদেরকে জীবনোপকরণ স্বরূপ যে সকল চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছেন, সেগুলোর উপর যেন তারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।” [সূরা হজ্জ্ব ২২ : ৩৪]

হাদীসে এসেছে,

وَعَنْ جَابِرٍ رضى الله عنه قَالَ: قَالَ رَسُولُ اَللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏”لَا تَذْبَحُوا إِلَّا مُسِنَّةً إِلَّا أَنْ يَعْسُرَ عَلَيْكُمْ فَتَذْبَحُوا جَذَعَةً مِنَ اَلضَّأْنِ

“তোমরা অবশ্যই নির্দিষ্ট বয়সের পশু কুরবানী করবে। তবে তা তোমাদের জন্য দুষ্কর হলে ছয় মাসের মেষ-শাবক কুরবানী করতে পার।” [মুসলিম : ১৯৬৩]

আর আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা ছাড়া অন্য জন্তু কুরবানী করেননি ও কুরবানী করতে বলেননি। তাই কুরবানী শুধু এগুলো দিয়েই করতে হবে। ইমাম মালিক রহ. এর মতে কুরবানীর জন্য সর্বোত্তম জন্তু হলো শিংওয়ালা সাদা-কালো দুম্বা। কারণ রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ধরণের দুম্বা কুরবানী করেছেন বলে সহীহ বুখারী ও মুসলিমের হাদীসে এসেছে। অধিকাংশ উলামাদের মতে, সবচেয়ে উৎকৃষ্ট কুরবানীর পশু হলো উট, অতঃপর গরু, তারপর মেষ (ভেড়া), তারপর ছাগল। আবার নর মেষ মাদী মেষ অপেক্ষা উত্তম। যেহেতু এ প্রসঙ্গে দলীল বর্ণিত হয়েছে। (আযওয়াউল বয়ান, ৫/৬৩৪)

একটি উট ও গরু-মহিষে সাত ব্যক্তি কুরবানীর জন্য শরীক হতে পারে। [মুসলিম : ১৩১৮] ইমাম শাওকানী বলেন, হজ্জের কুরবানীতে দশ এবং সাধারণ কুরবানীতে সাত ব্যক্তি শরীক হওয়াটাই সঠিক। (নায়লুল আওত্বার, ৮/১২৬)

ইমাম আবু হানিফার মতে শরিকানা কুরবানীতে সাত শরিকের অধিক হলে কারো কুরবানী বিশুদ্ধ হবে না।

যেমন হাদীসে এসেছে-

عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ قَالَ نَحَرْنَا مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم عَامَ الْحُدَيْبِيَةِ الْبَدَنَةَ عَنْ سَبْعَةٍ وَالْبَقَرَةَ عَنْ سَبْعَةٍ ‏.‏

“আমরা হুদাবিয়াতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে ছিলাম। তখন আমরা উট ও গরু দ্বারা সাত জনের পক্ষ থেকে কুরবানী দিয়েছি।” [মুসলিম : ১৩১৮, ইবনে মাজা : ৩১৩২]

কিন্তু মেষ বা ছাগলে ভাগাভাগি বৈধ নয়। তবে সওয়াবে একাধিক ব্যক্তিকে শরীক করা যাবে। সুতরাং একটি পরিবারের তরফ থেকে মাত্র একটি মেষ বা ছাগল যথেষ্ট হবে। তাতে সেই পরিবারের সদস্য সংখ্যা যতই হোক না কেন। গুণগত দিক দিয়ে উত্তম হলো কুরবানীর পশু হৃষ্টপুষ্ট, অধিক গোশত সম্পন্ন, নিখুঁত, দেখতে সুন্দর হওয়া।

(২) শরীয়তের দৃষ্টিতে কুরবানীর পশুর বয়সের দিকটা খেয়াল রাখা জরুরী। উট পাঁচ বছরের হতে হবে। গরু বা মহিষ দু‘বছরের হতে হবে। ছাগল, ভেড়া, দুম্বা হতে হবে এক বছর বয়সের। অবশ্য অসুবিধার ক্ষেত্রে ছয় মাস বয়সী মেষ কুরবানী করা যায়। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘দাতালো ছাড়া যবেহ করো না। তবে তা দুর্বল হলে ছয় মাসের মেষ যবেহ কর।’ [মুসলিম : ১৯৬৩]

(৩) কুরবানীর পশু যাবতীয় দোষ-ত্রুটি মুক্ত হতে হবে। যেমন হাদিসে এসেছে,

عَنْ الْبَرَاءَ بْنَ عَازِبٍ رضى الله عنه قَالَ: قَامَ فِينَا رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ ‏”‏ أَرْبَعٌ لاَ تَجُوزُ فِي الأَضَاحِي الْعَوْرَاءُ بَيِّنٌ عَوَرُهَا وَالْمَرِيضَةُ بَيِّنٌ مَرَضُهَا وَالْعَرْجَاءُ بَيِّنٌ ظَلْعُهَا وَالْكَسِيرُ الَّتِي لاَ تَنْقَى

সাহাবী বারা ইবনে আযেব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের মাঝে দাঁড়ালেন তারপর বললেন : চার ধরণের পশু, যা দিয়ে কুরবানী জায়েয হবে না। অন্ধ. যার অন্ধত্ব স্পষ্ট, রোগাক্রান্ত্র; যার রোগ স্পষ্ট, পঙ্গু; যার পগুত্ব স্পষ্ট এবং আহত; যার কোন অংগ ভেংগে গেছে। [আবূ দাউদ : ২৮০২]

অতএব এ চারের কোন এক ত্রুটিযুক্ত পশু দ্বারা কুরবানী সিদ্ধ হয় না। ইবনে কুদামাহ বলেন, “এ বিষয়ে কোন মতভেদ আছে কিনা তা আমরা জানি না।” [মুগনী, ১৩/৩৬৯]

কুরবানীর ওয়াক্ত বা সময় :

কুরবানী নির্দিষ্ট সময়ের সাথে সম্পর্কিত একটি ইবাদত। এ সময়ের পূর্বে যেমন কুরবানী আদায় হবে না তেমনি পরে করলেও আদায় হবে না। অবশ্য কাজা হিসেবে আদায় করলে অন্য কথা।

যারা ঈদের সালাত আদায় করবেন তাদের জন্য কুরবানীর সময় শুরু হবে ঈদের সালাত আদায় করার পর থেকে। যদি ঈদের সালাত আদায়ের পূর্বে কুরবানীর পশু যবেহ করা হয় তাহলে কুরবানী আদায় হবে না। যেমন হাদীসে এসেছে,

عَنِ الْبَرَاءِ بْنِ عَازِبٍ، قَالَ قَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم ‏”‏ إِنَّ أَوَّلَ مَا نَبْدَأُ فِي يَوْمِنَا هَذَا أَنْ نُصَلِّيَ، ثُمَّ نَرْجِعَ فَنَنْحَرَ، فَمَنْ فَعَلَ ذَلِكَ فَقَدْ أَصَابَ سُنَّتَنَا، وَمَنْ نَحَرَ قَبْلَ الصَّلاَةِ فَإِنَّمَا هُوَ لَحْمٌ قَدَّمَهُ لأَهْلِهِ، لَيْسَ مِنَ النُّسْكِ فِي شَىْءٍ.

“বারা ইবনে আযেব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি শুনেছি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুতবাতে বলেছেন, ‘এ দিনটি আমরা শুরু করব সালাত দিয়ে। অতঃপর সালাত থেকে ফিরে আমরা কুরবানী করব। যে এমন আমল করবে সে আমাদের আদর্শ সঠিকভাবে অনুসরণ করল। আর যে এর পূর্বে যবেহ করল সে তার পরিবারবর্গের জন্য গোশতের ব্যবস্থা করল। কুরবানীর কিছুই আদায় হলো না।” [বুখারী : ৯৬৫, ৫২২৬]

সালাত শেষ হওয়ার সাথে সাথে কুরবানীর পশু যবেহ না করে সালাতের খুতবা দু‘টি শেষ হওয়ার পর যবেহ করা ভাল। কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ রকম করেছেন। হাদীসে এসেছে,

عَنْ جُنْدَبٍ قَالَ صَلَّى النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم يَوْمَ النَّحْرِ ثُمَّ خَطَبَ، ثُمَّ ذَبَحَ.

“সাহাবী জুনদাব ইবনে সুফিয়ান আল-বাজালী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানীর দিন সালাত আদায় করলেন অতঃপর খুতবা দিলেন তারপর পশু যবেহ করলেন।” [বুখারী : ৯৮৫]

سَمِعْتُ جُنْدَبَ بْنَ سُفْيَانَ الْبَجَلِيَّ، قَالَ شَهِدْتُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم يَوْمَ النَّحْرِ فَقَالَ مَنْ ذَبَحَ قَبْلَ أَنْ يُصَلِّيَ فَلْيُعِدْ مَكَانَهَا أُخْرَى، وَمَنْ لَمْ يَذْبَحْ فَلْيَذْبَحْ. ‏

“জুনদাব ইবনে সুফিয়ান আরো বলেন, আমি কুরবানীর দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে ছিলাম। তিনি বলেন, যে ব্যক্তি সালাতের পূর্বে যবেহ করেছে সে যেন আবার অন্য স্থানে যবেহ করে। আর যে যবেহ করেনি সে যেন যবেহ করে।” [বুখারীর :  ৫৫৬২]

আর কুরবানীর সময় শেষ হবে যিলহজ্জ মাসের বারো তারিখের সূর্যাস্তের সাথে সাথে। অতএর কুরবানীর পশু যবেহ করার সময় হলো তিন দিন। যিলহজ্জ মাসের দশ, এগারো, বারো তারিখ। এটাই উলামায়ে কিরামের নিকট সর্বোত্তম মত হিসেবে প্রাধান্য পেয়েছে।

কুরবানী থেকে আমাদের শিক্ষা :

১.    ভোগ নয় ত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন।

২.    আল্লাহর সামনে নিঃশর্ত আনুগত্য প্রকাশ করা।

৩.    একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নৈকট্য অর্জন করার জন্য ইবাদত করা।

৪.    মহান প্রতিপালকের সাক্ষাতের জন্য সৎকর্ম করা।

৫.    প্রতিপালকের ইবাদতে কাউকে শরীক না করে।

৬.    কুরবানী মনের ঐকান্তিক আগ্রহ ছাড়া কবূল হয় না।

*সেক্রেটারী

সেন্টার ফর রিসার্চ এন্ড কমিউনিটি ডেভেলোপমেন্ট