০৩:৩৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ০৮ জুন ২০২৫, ২৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
ভোলা-বরিশাল সেতুর দাবিতে মানববন্ধন ভোলা জেলা ওলামা তলাবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বিলুপ্ত করায় বিমানবন্দরে এফবিসিসিএফএএ’র সংবাদ সম্মেলন ক্যারিয়ার বাংলাদেশের গোল টেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত দলিপাড়া ও দেশবাসীকে ঈদ-উল-ফিতরের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন আবু জাফর আলম উত্তরা ১১ নং সেক্টর ও দেশবাসীকে ঈদ-উল-ফিতরের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন অধ্যক্ষ সালাউদ্দিন ভূঁইয়া সেই গুলিবিদ্ধ ইমরান কে দেখতে গেলেন লুৎফুজ্জামান বাবর একাত্তরের ন্যায় ২৪ যোদ্ধারাও পাবে সকল সুবিধা-মুস্তাফিজ সেগুন গুম-খুনের শিকার ও চব্বিশের শহীদ পরিবারকে ঈদ উপহার দিলেন বিএনপি নেতা আমিনুল হক জাতিসঙ্ঘ শূন্য বর্জ্য দিবসে প্রফেসর ইউনূসকে অভিনন্দন জানালেন তুরস্কের ফার্স্ট লেডি চীনা বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার

কারাগার থেকে জানতে চান ড. আফিয়া সিদ্দিকী মুসলিম উম্মাহর কী অবস্থা?

কারাগারে কেমন আছেন শেকলবন্দি মুসলিম স্নায়ূবিজ্ঞানী ড. আফিয়া সিদ্দিকী

আন্তর্জাতিক ডেস্ক :
  • আপডেট সময় : ১২:৫২:৩৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ১০ জুন ২০২৩ ৫৫ বার পড়া হয়েছে
ভয়েস অব টাইম অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

কারাগারে বন্দি ড. আফিয়া সিদ্দিকী কেমন আছেন, ২০ বছর ধরে তার ওপর কতটা নির্মম ও পাশবিক আচরণ করা হয়েছে, তা জানতে উদগ্রীব বিশ্বের কোটি মানুষ। ছোট বোনকে দেখে এসে সেই সব প্রশ্নের লোমহর্ষক উত্তর ও হৃদয় বিবর্ণ করা বর্ণনা দিয়েছেন বড় বোন ড. ফৌজিয়া সিদ্দিকী।

কে এই আফিয়া সিদ্দিকী

ড. আফিয়া সিদ্দিকী যিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বিখ্যাত একজন মুসলিম স্নায়ুবিজ্ঞানী এবং একজন আলোচিত মহিলা। তিনি পাকিস্তানের করাচীর সম্ভ্রান্ত ও উচ্চ শিক্ষিত পরিবারে ১৯৭২ সালের ২ মার্চ জন্ম গ্রহণ করেন। পিএইচডি ডিগ্রিধারী এই মহিলাকে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবি আই  ২০০৩ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের সহযোগিতায় আল কায়েদা সাথে যোগাযোগ থাকার অভিযোগে পাকিস্তানের করাচির রাস্তা থেকে তার তিন সন্তানসহ গ্রেফতার করে। পরে প্রচলিত আইনের আওতায় না এনে পাকিস্তানের কারাগারে গ্রেফতার না রেখেই তাকে আফগানিস্তানের সামরিক ঘাঁটিতে তাকে ৫ বছর বন্দি করে রাখা হয়। ২০০৩ সালে তাকে যুক্তরাষ্ট্রের একটি গোপন কারাগারে স্থানাস্তর করা হয়। ৩৮ বছর বয়সী এই বিজ্ঞানীকে মার্কিন আদালত তাকে ৮৬ বছর কারাদন্ড দেয়।বন্দি অবস্থায় তার ওপর ধর্ষণসহ, ব্যাপক শারীরিক, মানসিক ও  অমানবিক নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে।

জন্ম সূত্রে এই উচ্চ শিক্ষিত মহিলা পাকিস্তানের নাগরিক। শিক্ষা জীবনে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ডিগ্রী ধারী পিএইচডি হোল্ডার। স্বনামধন্য এই স্নায়ুবিজ্ঞানী শিক্ষা জীবনে অসামান্য মেধার পরিচয় দেন। যুক্তরাষ্ট্রের ব্রন্ডেইস হার্ভার্ড  বিশ্ববিদ্যালয়  তাকে “ নিউরোলজি” বিষয়ে ডক্টরেট ডিগ্রী প্রদান করে। এছাড়াও শিক্ষা লাভের পর তিনি ২০০২ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের বসবাস করেন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করেন।এ ছাড়াও সম্মান সূচক ও অন্যান্য ডিগ্রীর ১৪০ টিরও বেশি সার্টিফিকেট তিনি অর্জন করেন।

আফিয়া সিদ্দিকীর বোন হলো ড. ফৌজিয়া সিদ্দিকী

ইতোমধ্যে তিন দফা ড. আফিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পেরেছেন তাঁর বোন। শেষ দফা সাক্ষাৎ করেছেন আইনজীবী নিয়ে। ২০ বছরের মধ্যে আফিয়ার পরিবারের পক্ষের কোনো আইনজীবীর এটাই প্রথম সাক্ষাৎ।

আফিয়ার নিয়োগ করা আইনজীবী না থাকায় কোনো ধরণের মানবিক সাপোর্ট তিনি পাচ্ছিলেন না। এমনকি তার জন্য কারাগারে পাঠানো অর্থের কানাকড়িও ২০ বছরের মধ্যে তিনি পাননি। তাকে পাঠানো অর্থ কোথায় গিয়েছে, সেই হদিসও নেই। এর কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি মার্কিন কারাকর্তপক্ষ।

প্রথম দফা সাক্ষাতের পর ড. ফৌজিয়া তার জন্য কিছু অর্থ জমা করেছিলেন, সেটাই প্রথমবার আফিয়ার হাতে পৌছেছে।

ড. আফিয়ার সঙ্গের সাক্ষাতের পর তাকে ছেড়ে আসার বেদনা এখনও প্রতি মুহূর্তে পীড়িত করছে ড. ফৌজিয়াকে। তিনি সাক্ষাতের কোনো কথাই ঠিক মতো দু’ মিনিট বলতে পারেন না। বারবার তার ভেতর ভেঙে কান্না আসে।

২০ বছর পর সাক্ষাতের পর বোনকে কারাগারে রেখে চলে আসার মতো ভারী যন্ত্রণার আর কিছু সম্ভবত নেই। এরপরও বোনোর মুক্তির জন্য তিনি দ্বারে দ্বারে যাচ্ছেন, সমাবেশে বক্তৃতা এবং স্যোসাল মিডিয়া ও গণমাধমকে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন। বোনের সঙ্গে সর্বশেষ সাক্ষাতের পর ড. ইয়াসির কাজির উদ্যোগে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের এক মসজিদে মুসলিম কমিউনিটির উদ্দেশ্যে তিনি বক্তব্যও রেখেছেন।

প্রথম দেখা যেমন ছিলো

২০ বছর পর বোনকে দেখতে যাচ্ছেন, বোনকে দেখার উচ্ছ্বাস ও বুক ভেঙে আসা উদ্বেলিত ঢেউয়ে আচ্ছন্ন ড. ফৌজিয়া। তার সময় যেনো কাটছে না, তর সইছে না। কিন্তু যাকে দেখতে যাচ্ছেন, তিনি এসবের কিছুই জানতেন না। জানতেন না তার সাথে কে দেখা করতে আসছেন। ২০ বছর ধরে কারাগারে শেকলবন্দি জীবন কাটানো আফিয়া দুনিয়ার প্রতি সব আশা-আকাঙক্ষা ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি জানেন, এক আল্লাহ ছাড়া তাঁর কেউ নেই। তার বোন তাকে দেখতে আসছেন, এটা তার কল্পনাতেও ছিলো না।

শেকলে পরে কে আসে হায়!

প্রথম দিন (৩১ মে, ২০২৩) আধাঘন্টার চেকাপের পর কারাগারের ভেতর নিয়ে যাওয়া হয় ড. ফৌজিয়াদের। ভেতরে যাওয়ার পরই শেকলপরা বন্দিদের নড়াচড়ার শব্দ কানে আসতে থাকে তাদের। একসময় একটি ছোট কক্ষে কারারক্ষীরা তাদের পৌছে দেন। কক্ষের বিপরীত দিকের দরজা খোলার আগে ফৌজিয়ারা শুনতে পেলেন, ভারি শেকল টেনে টেনে কেউ একজন এই কক্ষের দিকে আসছেন! ফৌজিয়ার বুঝতে দেরি হলো না, কাকে আনা হচ্ছে এখানে। কল্পনায় বোনকে দেখে বেদনায় চৌচির হয়ে যাচ্ছিলো তাঁর হৃদয়।

কক্ষের দিকে আসতে আসতে আফিয়া কারারক্ষীদের বলছেন, তোমরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? তারা বললো, তোমার ভিজিটর এসেছে। ভিজিটরের পরিচয় সম্পর্কে কোনো কিছুই তারা জানাচ্ছিলো না। আফিয়া বলছিলেন, আমার জন্য ভিজিটর কোথা থেকে আসবে? আমি কারও সাথে দেখা করতে চাই না! একটু পরই ওই পাশের দরোজা খুলে গেলো। ভেতরে এলেন আফিয়া সিদ্দিকী।

বোনকে দেখে বিস্মিত উৎকণ্ঠিত আফিয়া!

২০ বছর পর চোখাচুখি হলো দু’বোনের। সামনা সামনি দেখলেন একে অপরকে। এতো বছর পর বোনকে দেখে যেখানে উচ্ছ্বসিত হবার কথা, সেখানে তাকে দেখেই উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েন আফিয়া। অস্থির হয়ে বলতে থাকেন, তুমি এখানে কীভাবে! তোমাকেও কি তারা বন্দি করে নিয়ে এসেছে! ফৌজিয়া তাকে সান্ত্বনা দেন। বলেন, ভয় পেয়ো না, আমরা তোমাকে দেখতে এসেছি।

দুুই বোনের হাতে হাত মধ্যখানে কাঁচ

২০ বছর পর দুই বোনের দেখা। কিন্তু কেউ কাউকে জড়িয়ে ধরতে পারলেন না। এতটুকু স্পর্শও না। মধ্যখানে আড়াল হয়ে থাকলো ভারি, তবে স্বচ্ছ কাঁচ। দুইবোন কাঁচের সাথে শরীর মিশিয়ে দাঁড়ালেন। কাঁচের ওপর হাত রেখে হাতের স্পর্শ নিলেন!

আলাপ টেলিফেনে, হচ্ছে রেকর্ড, পাশে গার্ড

দুই বোন কাঁচের দেয়ালের দু’পাশে। কথা বলার জন্য দুই পাশেই টেলিফোন রাখা। বিস্ময়, উৎকণ্ঠা কাটিয়ে ওঠার পর রিসিভার হাতে তুলে নেন আফিয়া। কথা বলতে থাকেন দুই বোন। কত অশ্রু আর হাহাকারে কথা। কারও চোখ কারও মুখ থেকে সরছে না। কিন্তু বন্দিখানার আলাপ, দুই পাশেই কারারক্ষী সতর্ক দৃষ্টি, নিবিড় মনযোগ। তার ওপর সিসি ক্যামেরার পর্যবেক্ষ ও রেকর্ড। কতটাইবা বলা যায়। যা বলার, তা কি আর মুখে আনা যায়!

 ভেঙ্গেছে দাঁত, ঝলসানো মুখ

আমারা প্রথম পর্বে জেনেছি, ড. আফিয়ার উপরের পাটির চারটি দাঁত পড়ে গিয়েছে। কিভাবে এই দাঁত পড়েছে? এর উত্তরে ধোয়াসা রয়েছে। ফৌজিয়াদের বক্তব্যে মনে হচ্ছে, কারা কর্তৃপক্ষ বলছেন, অন্য বন্দিদের হাম-লায় আফিয়া আহ-ত হয়েছেন এবং তারা তাঁর দাঁত উপড়ে ফেলেছে। কিন্তু যে কারা-মেডিকেলে সকল বন্দিই শেকলে আবদ্ধ তারা কীভাবে আফিয়ার ওপর হাম-লা করবে! কেনো করবে! এতে মনে হয়, হাম-লার ব্যাপারটি সত্যকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টামাত্র। নির্যাতন করেই তাঁর দাঁত ভেঙে ফেলা হয়েছে।

দাঁতের ব্যাপারটি ছাড়াও ফৌজিয়া জানিয়েছেন, ড. আফিয়ার মুখের একপাশে পোড়া ক্ষত দেখেছেন তিনি। এই ব্যাপারটি বলতে গিয়ে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন এবং থেমে যান। তাঁর ওপর নির্যা-তনের প্রসঙ্গ বলতে যেয়েও, থেমে গিয়ে তিনি বলেন, সব কি বলা যায়? বোনের সাথে এটাই শেষ দেখা হোক, আমি তা চাচ্ছি না! এছাড়াও তার কানের পেছনে ক্ষত রয়েছে। একারণে আফিয়ার শ্রবণশক্তিতেও সমস্যা হচ্ছে বলে তিনি জানিয়েছেন।

কড়া নজরদারি বাথরুমেও সিসি ক্যামেরা

ড. আফিয়াকে যে কারা-গারে রাখা হয়েছে, সেটি মানসিক রোগীদের জন্য বিশেষায়িত একটি মেডিকেল কারা-গার। এটি আমেরিকার হাই সিকিউরড কারা-গারের অন্যতম। একই সঙ্গে দুর্নীতি ও পাশবিক সব অপরাধের জন্যও এই কারা-গার কুখ্যাত।

এখানে বন্দিরা সব শেকল পরা। কারা-গারের ভেতর-বাইর, বন্দিরের কক্ষ এমনকি বাথরুমেও সিসি ক্যামেরা বসানো! উচ্চ প্রযুক্তির সিসি ক্যামেরা বেষ্টিত কারা-গারে একটি পিঁপড়েরও ক্যামেরার চোখ ফাঁকি দেয়ার জো নেই।

এই অবস্থায় একজন সাধারণ মানুষকে একদিন রাখলেই তার পাগল হয়ে যাওয়ার কথা। সেখানে মুসলিম স্নায়ুবিজ্ঞানী, হাফিজে কুরআন, আলিমা, অসম্ভবব আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন বোন ড. আফিয়া সিদ্দিকী আছেন এতোটি বছর থেকে! এই অবস্থাকে তিনি জাহান্নাম ছাড়া কিছুই ভাবতে পারেন না। এই জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেতে তিনি বেচাইন। উদগ্রীব।

২০ বছর পর খেলেন চা

ড. ফৌজিয়া জানিয়েছেন, আমেরিকায় বন্দি জানার পর থেকেই আফিয়ার জন্য তারা কারাগারে অর্থ পাঠাচ্ছিলেন। দেখা হওয়ার পর জানলেন একটা টাকাও তার হাতে পৌঁছেনি! তাদের পাঠানো অর্থ কোথায় গিয়েছে, সেই হদিসও কেউ দিচ্ছে না। প্রথম দিন দেখা করার পর তারা কিছু ডলার দিয়ে আসেন। পর দিন সাক্ষাতের শুরুতেই উচ্ছ্বসিত আফিয়া বোনকে জানান, আজকে আমি চা খেয়েছি! বন্দি হওয়ার পর এই প্রথম তিনি নিজের টাকায় কিছু কিনি খেতে পারলেন!

সন্দেহাতীতবাবে দোষী প্রমাণিত হওয়ার আগে নির্দোষ বলে বিবেচিত হয়। ফলে সকল সুবিধা পায়। কিন্তু ডা. আফিয়া তা পাননি বং নির্যাতনের শিকার হন।

মুসলিম উম্মাহর কী অবস্থা জানতে চান আফিয়া!

২০ বছর থেকে বন্দি আফিয়া, যার নিজের খোঁজ নেওয়ার কেউ নেই। সেই আফিয়া বোনের সাথে আলাপের এক পর্যায়ে জানতে চান, বিশ্ব মুসলিমরা কেমন আছে? কী অবস্থা তাদের? যে মুসলিমরা তাকে ভুলে গিয়েছে। ২০ বছরের অসহায় একাকিত্ব ও নির্মম বন্দিজীবনের পরও তাদের অবস্থা জানতে চাচ্ছেন আফিয়া! কতটা উম্মাহপ্রাণ এই মহিয়সী।

কাঁচের দেয়াল ভাঙ্গবে আফিয়া আসবেন

কারা-গার এক পরীক্ষার নাম। মুমিনের জন্য দুনিয়াকে কারা-গারই আখ্যা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমাদের কারা-গার আর ড. আফিয়াদের কারা-গার ভিন্ন। আমরা নিজেদের দেশের কারাগারে এক রাত কাটাতে পারি না। কিন্তু তিনি আছেন কা-ফের বেষ্টিত কারা-গারে। তার প্রতিটা মুহূর্ত কীভাবে যাচ্ছে তিনি জানেন। আল্লাহ তাঁকে সঙ্গ দিন, তার অন্তরে প্রশান্তি দিন।

ড. ফৌজিয়া বলেছেন, যেদিন তারা কারাগারে পৌছেন, তখন সূর্য উদিত হচ্ছিলো। কারাগারে উপরে উদিত ভোরের সেই ছবির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ইনশাআল্লাহ, একদিন আফিয়ার সঙ্গে নতুন ভোরর সূর্যোদয় দেখবো। এর জন্য ভাঙতে হবে কাঁচের দেয়াল।’ সেই দেয়াল ভাঙবে, ভাঙতেই হবে।

নিউজটি শেয়ার করুন

কারাগার থেকে জানতে চান ড. আফিয়া সিদ্দিকী মুসলিম উম্মাহর কী অবস্থা?

কারাগারে কেমন আছেন শেকলবন্দি মুসলিম স্নায়ূবিজ্ঞানী ড. আফিয়া সিদ্দিকী

আপডেট সময় : ১২:৫২:৩৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ১০ জুন ২০২৩

কারাগারে বন্দি ড. আফিয়া সিদ্দিকী কেমন আছেন, ২০ বছর ধরে তার ওপর কতটা নির্মম ও পাশবিক আচরণ করা হয়েছে, তা জানতে উদগ্রীব বিশ্বের কোটি মানুষ। ছোট বোনকে দেখে এসে সেই সব প্রশ্নের লোমহর্ষক উত্তর ও হৃদয় বিবর্ণ করা বর্ণনা দিয়েছেন বড় বোন ড. ফৌজিয়া সিদ্দিকী।

কে এই আফিয়া সিদ্দিকী

ড. আফিয়া সিদ্দিকী যিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বিখ্যাত একজন মুসলিম স্নায়ুবিজ্ঞানী এবং একজন আলোচিত মহিলা। তিনি পাকিস্তানের করাচীর সম্ভ্রান্ত ও উচ্চ শিক্ষিত পরিবারে ১৯৭২ সালের ২ মার্চ জন্ম গ্রহণ করেন। পিএইচডি ডিগ্রিধারী এই মহিলাকে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবি আই  ২০০৩ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের সহযোগিতায় আল কায়েদা সাথে যোগাযোগ থাকার অভিযোগে পাকিস্তানের করাচির রাস্তা থেকে তার তিন সন্তানসহ গ্রেফতার করে। পরে প্রচলিত আইনের আওতায় না এনে পাকিস্তানের কারাগারে গ্রেফতার না রেখেই তাকে আফগানিস্তানের সামরিক ঘাঁটিতে তাকে ৫ বছর বন্দি করে রাখা হয়। ২০০৩ সালে তাকে যুক্তরাষ্ট্রের একটি গোপন কারাগারে স্থানাস্তর করা হয়। ৩৮ বছর বয়সী এই বিজ্ঞানীকে মার্কিন আদালত তাকে ৮৬ বছর কারাদন্ড দেয়।বন্দি অবস্থায় তার ওপর ধর্ষণসহ, ব্যাপক শারীরিক, মানসিক ও  অমানবিক নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে।

জন্ম সূত্রে এই উচ্চ শিক্ষিত মহিলা পাকিস্তানের নাগরিক। শিক্ষা জীবনে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ডিগ্রী ধারী পিএইচডি হোল্ডার। স্বনামধন্য এই স্নায়ুবিজ্ঞানী শিক্ষা জীবনে অসামান্য মেধার পরিচয় দেন। যুক্তরাষ্ট্রের ব্রন্ডেইস হার্ভার্ড  বিশ্ববিদ্যালয়  তাকে “ নিউরোলজি” বিষয়ে ডক্টরেট ডিগ্রী প্রদান করে। এছাড়াও শিক্ষা লাভের পর তিনি ২০০২ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের বসবাস করেন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করেন।এ ছাড়াও সম্মান সূচক ও অন্যান্য ডিগ্রীর ১৪০ টিরও বেশি সার্টিফিকেট তিনি অর্জন করেন।

আফিয়া সিদ্দিকীর বোন হলো ড. ফৌজিয়া সিদ্দিকী

ইতোমধ্যে তিন দফা ড. আফিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পেরেছেন তাঁর বোন। শেষ দফা সাক্ষাৎ করেছেন আইনজীবী নিয়ে। ২০ বছরের মধ্যে আফিয়ার পরিবারের পক্ষের কোনো আইনজীবীর এটাই প্রথম সাক্ষাৎ।

আফিয়ার নিয়োগ করা আইনজীবী না থাকায় কোনো ধরণের মানবিক সাপোর্ট তিনি পাচ্ছিলেন না। এমনকি তার জন্য কারাগারে পাঠানো অর্থের কানাকড়িও ২০ বছরের মধ্যে তিনি পাননি। তাকে পাঠানো অর্থ কোথায় গিয়েছে, সেই হদিসও নেই। এর কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি মার্কিন কারাকর্তপক্ষ।

প্রথম দফা সাক্ষাতের পর ড. ফৌজিয়া তার জন্য কিছু অর্থ জমা করেছিলেন, সেটাই প্রথমবার আফিয়ার হাতে পৌছেছে।

ড. আফিয়ার সঙ্গের সাক্ষাতের পর তাকে ছেড়ে আসার বেদনা এখনও প্রতি মুহূর্তে পীড়িত করছে ড. ফৌজিয়াকে। তিনি সাক্ষাতের কোনো কথাই ঠিক মতো দু’ মিনিট বলতে পারেন না। বারবার তার ভেতর ভেঙে কান্না আসে।

২০ বছর পর সাক্ষাতের পর বোনকে কারাগারে রেখে চলে আসার মতো ভারী যন্ত্রণার আর কিছু সম্ভবত নেই। এরপরও বোনোর মুক্তির জন্য তিনি দ্বারে দ্বারে যাচ্ছেন, সমাবেশে বক্তৃতা এবং স্যোসাল মিডিয়া ও গণমাধমকে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন। বোনের সঙ্গে সর্বশেষ সাক্ষাতের পর ড. ইয়াসির কাজির উদ্যোগে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের এক মসজিদে মুসলিম কমিউনিটির উদ্দেশ্যে তিনি বক্তব্যও রেখেছেন।

প্রথম দেখা যেমন ছিলো

২০ বছর পর বোনকে দেখতে যাচ্ছেন, বোনকে দেখার উচ্ছ্বাস ও বুক ভেঙে আসা উদ্বেলিত ঢেউয়ে আচ্ছন্ন ড. ফৌজিয়া। তার সময় যেনো কাটছে না, তর সইছে না। কিন্তু যাকে দেখতে যাচ্ছেন, তিনি এসবের কিছুই জানতেন না। জানতেন না তার সাথে কে দেখা করতে আসছেন। ২০ বছর ধরে কারাগারে শেকলবন্দি জীবন কাটানো আফিয়া দুনিয়ার প্রতি সব আশা-আকাঙক্ষা ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি জানেন, এক আল্লাহ ছাড়া তাঁর কেউ নেই। তার বোন তাকে দেখতে আসছেন, এটা তার কল্পনাতেও ছিলো না।

শেকলে পরে কে আসে হায়!

প্রথম দিন (৩১ মে, ২০২৩) আধাঘন্টার চেকাপের পর কারাগারের ভেতর নিয়ে যাওয়া হয় ড. ফৌজিয়াদের। ভেতরে যাওয়ার পরই শেকলপরা বন্দিদের নড়াচড়ার শব্দ কানে আসতে থাকে তাদের। একসময় একটি ছোট কক্ষে কারারক্ষীরা তাদের পৌছে দেন। কক্ষের বিপরীত দিকের দরজা খোলার আগে ফৌজিয়ারা শুনতে পেলেন, ভারি শেকল টেনে টেনে কেউ একজন এই কক্ষের দিকে আসছেন! ফৌজিয়ার বুঝতে দেরি হলো না, কাকে আনা হচ্ছে এখানে। কল্পনায় বোনকে দেখে বেদনায় চৌচির হয়ে যাচ্ছিলো তাঁর হৃদয়।

কক্ষের দিকে আসতে আসতে আফিয়া কারারক্ষীদের বলছেন, তোমরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? তারা বললো, তোমার ভিজিটর এসেছে। ভিজিটরের পরিচয় সম্পর্কে কোনো কিছুই তারা জানাচ্ছিলো না। আফিয়া বলছিলেন, আমার জন্য ভিজিটর কোথা থেকে আসবে? আমি কারও সাথে দেখা করতে চাই না! একটু পরই ওই পাশের দরোজা খুলে গেলো। ভেতরে এলেন আফিয়া সিদ্দিকী।

বোনকে দেখে বিস্মিত উৎকণ্ঠিত আফিয়া!

২০ বছর পর চোখাচুখি হলো দু’বোনের। সামনা সামনি দেখলেন একে অপরকে। এতো বছর পর বোনকে দেখে যেখানে উচ্ছ্বসিত হবার কথা, সেখানে তাকে দেখেই উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েন আফিয়া। অস্থির হয়ে বলতে থাকেন, তুমি এখানে কীভাবে! তোমাকেও কি তারা বন্দি করে নিয়ে এসেছে! ফৌজিয়া তাকে সান্ত্বনা দেন। বলেন, ভয় পেয়ো না, আমরা তোমাকে দেখতে এসেছি।

দুুই বোনের হাতে হাত মধ্যখানে কাঁচ

২০ বছর পর দুই বোনের দেখা। কিন্তু কেউ কাউকে জড়িয়ে ধরতে পারলেন না। এতটুকু স্পর্শও না। মধ্যখানে আড়াল হয়ে থাকলো ভারি, তবে স্বচ্ছ কাঁচ। দুইবোন কাঁচের সাথে শরীর মিশিয়ে দাঁড়ালেন। কাঁচের ওপর হাত রেখে হাতের স্পর্শ নিলেন!

আলাপ টেলিফেনে, হচ্ছে রেকর্ড, পাশে গার্ড

দুই বোন কাঁচের দেয়ালের দু’পাশে। কথা বলার জন্য দুই পাশেই টেলিফোন রাখা। বিস্ময়, উৎকণ্ঠা কাটিয়ে ওঠার পর রিসিভার হাতে তুলে নেন আফিয়া। কথা বলতে থাকেন দুই বোন। কত অশ্রু আর হাহাকারে কথা। কারও চোখ কারও মুখ থেকে সরছে না। কিন্তু বন্দিখানার আলাপ, দুই পাশেই কারারক্ষী সতর্ক দৃষ্টি, নিবিড় মনযোগ। তার ওপর সিসি ক্যামেরার পর্যবেক্ষ ও রেকর্ড। কতটাইবা বলা যায়। যা বলার, তা কি আর মুখে আনা যায়!

 ভেঙ্গেছে দাঁত, ঝলসানো মুখ

আমারা প্রথম পর্বে জেনেছি, ড. আফিয়ার উপরের পাটির চারটি দাঁত পড়ে গিয়েছে। কিভাবে এই দাঁত পড়েছে? এর উত্তরে ধোয়াসা রয়েছে। ফৌজিয়াদের বক্তব্যে মনে হচ্ছে, কারা কর্তৃপক্ষ বলছেন, অন্য বন্দিদের হাম-লায় আফিয়া আহ-ত হয়েছেন এবং তারা তাঁর দাঁত উপড়ে ফেলেছে। কিন্তু যে কারা-মেডিকেলে সকল বন্দিই শেকলে আবদ্ধ তারা কীভাবে আফিয়ার ওপর হাম-লা করবে! কেনো করবে! এতে মনে হয়, হাম-লার ব্যাপারটি সত্যকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টামাত্র। নির্যাতন করেই তাঁর দাঁত ভেঙে ফেলা হয়েছে।

দাঁতের ব্যাপারটি ছাড়াও ফৌজিয়া জানিয়েছেন, ড. আফিয়ার মুখের একপাশে পোড়া ক্ষত দেখেছেন তিনি। এই ব্যাপারটি বলতে গিয়ে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন এবং থেমে যান। তাঁর ওপর নির্যা-তনের প্রসঙ্গ বলতে যেয়েও, থেমে গিয়ে তিনি বলেন, সব কি বলা যায়? বোনের সাথে এটাই শেষ দেখা হোক, আমি তা চাচ্ছি না! এছাড়াও তার কানের পেছনে ক্ষত রয়েছে। একারণে আফিয়ার শ্রবণশক্তিতেও সমস্যা হচ্ছে বলে তিনি জানিয়েছেন।

কড়া নজরদারি বাথরুমেও সিসি ক্যামেরা

ড. আফিয়াকে যে কারা-গারে রাখা হয়েছে, সেটি মানসিক রোগীদের জন্য বিশেষায়িত একটি মেডিকেল কারা-গার। এটি আমেরিকার হাই সিকিউরড কারা-গারের অন্যতম। একই সঙ্গে দুর্নীতি ও পাশবিক সব অপরাধের জন্যও এই কারা-গার কুখ্যাত।

এখানে বন্দিরা সব শেকল পরা। কারা-গারের ভেতর-বাইর, বন্দিরের কক্ষ এমনকি বাথরুমেও সিসি ক্যামেরা বসানো! উচ্চ প্রযুক্তির সিসি ক্যামেরা বেষ্টিত কারা-গারে একটি পিঁপড়েরও ক্যামেরার চোখ ফাঁকি দেয়ার জো নেই।

এই অবস্থায় একজন সাধারণ মানুষকে একদিন রাখলেই তার পাগল হয়ে যাওয়ার কথা। সেখানে মুসলিম স্নায়ুবিজ্ঞানী, হাফিজে কুরআন, আলিমা, অসম্ভবব আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন বোন ড. আফিয়া সিদ্দিকী আছেন এতোটি বছর থেকে! এই অবস্থাকে তিনি জাহান্নাম ছাড়া কিছুই ভাবতে পারেন না। এই জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেতে তিনি বেচাইন। উদগ্রীব।

২০ বছর পর খেলেন চা

ড. ফৌজিয়া জানিয়েছেন, আমেরিকায় বন্দি জানার পর থেকেই আফিয়ার জন্য তারা কারাগারে অর্থ পাঠাচ্ছিলেন। দেখা হওয়ার পর জানলেন একটা টাকাও তার হাতে পৌঁছেনি! তাদের পাঠানো অর্থ কোথায় গিয়েছে, সেই হদিসও কেউ দিচ্ছে না। প্রথম দিন দেখা করার পর তারা কিছু ডলার দিয়ে আসেন। পর দিন সাক্ষাতের শুরুতেই উচ্ছ্বসিত আফিয়া বোনকে জানান, আজকে আমি চা খেয়েছি! বন্দি হওয়ার পর এই প্রথম তিনি নিজের টাকায় কিছু কিনি খেতে পারলেন!

সন্দেহাতীতবাবে দোষী প্রমাণিত হওয়ার আগে নির্দোষ বলে বিবেচিত হয়। ফলে সকল সুবিধা পায়। কিন্তু ডা. আফিয়া তা পাননি বং নির্যাতনের শিকার হন।

মুসলিম উম্মাহর কী অবস্থা জানতে চান আফিয়া!

২০ বছর থেকে বন্দি আফিয়া, যার নিজের খোঁজ নেওয়ার কেউ নেই। সেই আফিয়া বোনের সাথে আলাপের এক পর্যায়ে জানতে চান, বিশ্ব মুসলিমরা কেমন আছে? কী অবস্থা তাদের? যে মুসলিমরা তাকে ভুলে গিয়েছে। ২০ বছরের অসহায় একাকিত্ব ও নির্মম বন্দিজীবনের পরও তাদের অবস্থা জানতে চাচ্ছেন আফিয়া! কতটা উম্মাহপ্রাণ এই মহিয়সী।

কাঁচের দেয়াল ভাঙ্গবে আফিয়া আসবেন

কারা-গার এক পরীক্ষার নাম। মুমিনের জন্য দুনিয়াকে কারা-গারই আখ্যা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমাদের কারা-গার আর ড. আফিয়াদের কারা-গার ভিন্ন। আমরা নিজেদের দেশের কারাগারে এক রাত কাটাতে পারি না। কিন্তু তিনি আছেন কা-ফের বেষ্টিত কারা-গারে। তার প্রতিটা মুহূর্ত কীভাবে যাচ্ছে তিনি জানেন। আল্লাহ তাঁকে সঙ্গ দিন, তার অন্তরে প্রশান্তি দিন।

ড. ফৌজিয়া বলেছেন, যেদিন তারা কারাগারে পৌছেন, তখন সূর্য উদিত হচ্ছিলো। কারাগারে উপরে উদিত ভোরের সেই ছবির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ইনশাআল্লাহ, একদিন আফিয়ার সঙ্গে নতুন ভোরর সূর্যোদয় দেখবো। এর জন্য ভাঙতে হবে কাঁচের দেয়াল।’ সেই দেয়াল ভাঙবে, ভাঙতেই হবে।