০২:৫১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২০ জুন ২০২৫, ৫ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
ভোলা-বরিশাল সেতুর দাবিতে মানববন্ধন ভোলা জেলা ওলামা তলাবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বিলুপ্ত করায় বিমানবন্দরে এফবিসিসিএফএএ’র সংবাদ সম্মেলন ক্যারিয়ার বাংলাদেশের গোল টেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত দলিপাড়া ও দেশবাসীকে ঈদ-উল-ফিতরের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন আবু জাফর আলম উত্তরা ১১ নং সেক্টর ও দেশবাসীকে ঈদ-উল-ফিতরের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন অধ্যক্ষ সালাউদ্দিন ভূঁইয়া সেই গুলিবিদ্ধ ইমরান কে দেখতে গেলেন লুৎফুজ্জামান বাবর একাত্তরের ন্যায় ২৪ যোদ্ধারাও পাবে সকল সুবিধা-মুস্তাফিজ সেগুন গুম-খুনের শিকার ও চব্বিশের শহীদ পরিবারকে ঈদ উপহার দিলেন বিএনপি নেতা আমিনুল হক জাতিসঙ্ঘ শূন্য বর্জ্য দিবসে প্রফেসর ইউনূসকে অভিনন্দন জানালেন তুরস্কের ফার্স্ট লেডি চীনা বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার

আমরা জাতীয় খিদমতের লক্ষ্যে কতটুকু প্রস্তুতি নিচ্ছি?

কওমী সনদ স্বীকৃতির ইতিকথা 

  • আপডেট সময় : ০৪:১৩:৩৮ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৪ জুন ২০২৩ ২০১ বার পড়া হয়েছে
ভয়েস অব টাইম অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

শাইখুল হাদীস রুহুল আমীন খাঁন উজানী

-প্রিন্সিপাল জামিয়াতুস সাহাব ঢাকা

২০১৭ ইং সালটি কওমী মাদরাসা ইতিহাসে এক স্মরণীয় বছর। বহু চড়াই-উতরাই পার হয়ে শেষ পর্যন্ত কওমী মাদরাসা শিক্ষা সনদের সরকারি স্বীকৃতি বর্তমান প্রজন্মের জন্য কিছু কথা সংক্ষেপে বলে রাখা প্রয়োজন।

আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে যখন ক্ষমতায় আসে আমাদের উজানির মরহুম মাওলানা আব্দুল আউয়াল সাহেবকে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজি করা হয়। আমাকে করা হলো ইসলামিক ফাউন্ডেশন-এর বোর্ড অব গভর্নর সদস্য। ফাউন্ডেশন একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেশের সর্বস্তরের জনতার সাথে আমাদের স্বাভাবিকভাবে সম্পর্ক হবার সুবাদে একটি বিষয় আমার দৃষ্টি কাড়ে, দাগ কাটে। তা হচ্ছে কওমী মাদরাসা অঙ্গন থেকে ইসলামিক ফাউন্ডেশনে কাউকে কোন চাকরি দেয়ার ব্যবস্থা না থাকা। যেহেতু তাদের সার্টিফিকেট নেই।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে সুদূর প্রসারী লক্ষ্য নিয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এর অন্যতম একটি হলো ইসলামের অগ্রণী মনীষীদের লেখা আরবী, ফার্সি ও উর্দু ইত্যাদি গ্রন্থাবলী মাতৃ ভাষায় অনুবাদ করে বাংলা ভাষা-ভাষীদের কাছে পরিবেশন করা, এবং মদীনার খাটি ইসলামের রূপটি সাধারণ মুসলমানদের সামনে পেশ করা। আল্লাহর মেহেরবানীতে সেই লক্ষ্যে ইসলামিক ফাউন্ডেশন শুরু থেকে বহু সফলকাম হয়ে আসছে। এর দ্বারা বাংলা ভাষা ও সাহিত্য হয়েছে যথেষ্ট সমৃদ্ধশালী। দেশের সিংহভাগ শিক্ষিত মানুষ এখনো জানতে পারেনি বা পেরে উঠেনি এই কাজ কারা করেছে? এদিকে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উত্তোরণের পরিমাণ কতটুকু বিশেষ করে মাতৃভাষা চর্চায় এই প্রতিষ্ঠান কতটুকু অগ্রণী। অথচ মাতৃভাষায় ভাষান্তরের ক্ষেত্রে কওমী ওলামায়ে কিরাম মাতৃভাষা সাহিত্য সেবায় এত শীর্ষে থাকা সত্ত্বেও এবং দেশের বরেণ্য শিক্ষিতদের শিক্ষাগুরু হওয়া সত্ত্বেও তাদের জায়গা হচ্ছে নিরক্ষরদের জীর্ণ তালিকায়।

পবিত্র কোরআন ও হাদিস গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে হাজার হাজার পৃষ্ঠা গ্রন্থ যারা প্রকাশ করেছেন এবং করাচ্ছেন তারা আছেন মূর্খদের অবহেলিত কাতারে। আমি তখন ভাবতাম স্বয়ং সক্রেটিস আর এরিস্টোটল যদি থাকতেন তাদের নাম হয়তো কওমীদের সাথেই মূর্খদের কাতারে থাকতো। কেননা তারা তো গতানুগতিক স্কুল, হাইস্কুল, কলেজ, মাদরাসা-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নয়।

এক কথায় এই মূর্খতার ট্রেডমার্ক থেকে কওমী শিক্ষিতদের পরিত্রাণের জন্য মাঠে নেমে গেলাম। মরহুম মাওলানা আব্দুল আউয়াল সাহেব সহ শীর্ষ ব্যক্তিবর্গের নিকট বেশী বেশী দৌড়াতে লাগলাম। সাথে রাখতাম অধ্যক্ষ সৈয়দ মাওলানা ওহীদুজ্জামান সাহেব, মাওলানা রিয়াজুল ইসলাম মনির, অধ্যক্ষ মাসুদুর রহমান বিক্রমপুরীদেরকে। একপর্যায়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তদানীন্তন রাজনৈতিক উপদেষ্টা ডক্টর আব্দুল মালেকের সাথে আমাদের বৈঠক হয়। সরকারি পর্যায়ে মোটামুটি সাড়া পড়ে গেছে।

পরিশেষে হাজার ১৯৯৯ সালের ১৩ ই মার্চ জাতীয় প্রেসক্লাবে ভিআইপি লাউঞ্জে ওলামা-মাশায়েখদের সভাপতি হিসেবে আমার সভাপতিত্বে সর্বপ্রথম মাদরাসা শিক্ষা সনদের সরকারি স্বীকৃতির দাবিতে প্রেস কনফারেন্স করে দেশের আলেম-ওলামা ও সূধীজন এতে অংশগ্রহণ করেন

প্রথম সারির দৈনিক পত্রিকাগুলো আন্তরিকতার সাথে আকর্ষণীয় শিরোনামে সংবাদটি কভারেজ করে। বাম পত্রিকাগুলোও কোনো কার্পণ্য করেনি বরং খুবই চমৎকার ভাবে ফলাও করে। আমি অতীতে বহুবার দেখেছি মানবতার স্বপক্ষের যৌক্তিক দাবি উত্থাপন করলে আমাদের গৃহপালিত বন্ধুরা পিছুটান দেয়। তাই দেখেছি সদিচ্ছা-কল্যাণকামিতার সাদামাটা কর্মকাণ্ডের এ্যাকশন যে অকল্পনীয় প্রত্যক্ষ করেছি জীবনে শতবার। এবারও করলাম। এই দাবি উত্থাপন করার পর দেশের অনেক উলামার কাছে ধিকৃত হয়েছি। কওমী মাদরাসা স্বীকৃতি চাইতে গিয়ে নিজের যেন স্বীকৃতি হারা হয়েছি। স্বীকৃতি হারা হয়েছে মাদরাসাগুলো। কলেজ করার চক্রান্তে নাকি আমি অবতীর্ণ হয়েছি। আল্লাহ আমাদের সকলকে মাফ করুন। আমাকে তখন বলা হতো যাদের জন্য স্বীকৃতি চান, তারা তো আপনাকে প্রত্যাখ্যান করবে। আমি জবাব দিলাম কোন অসুবিধা নেই। ফল পাকলে গাছ ফলকে ছেড়ে দেয়, এটাই স্বাভাবিক।  কেউ ত্যাগে শান্ত কেউ ভোগে।

আরেকটি কথা উল্লেখ না করলেই নয়, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে স্বাধীনতার পর বিভিন্ন প্রচার মাধ্যম অপপ্রচারের মাধ্যমে উলামায়ে কিরামকে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিপক্ষ চিহ্নিত করার জন্য দুইটা মহল সোচ্চার ছিল। উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর পাঁয়তারা করছিল। যার দুঃখজনক পরিণতি দাঁড়িয়েছিল আলেম-ওলামা বললেই মনে করা হতো রাজাকার-আলবদর। বিষয়টি কিন্তু সম্পূর্ণ ষড়যন্ত্রমূলক। এটা আমাকে ও আমাদেরকে দারুণভাবে ব্যথিত করে তোলেছিল।

আমরা গুটিকয়েকজন বিষয়টি নিয়ে ভাবতাম। এ ভাবনার ফলশ্রুতিতে ১০ জুলাই ১৯৮৮ ইং জাতীয় প্রেসক্লাবে মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদ ও মুক্তিযুদ্ধা সংগ্রাম পরিষদের যৌথ উদ্যোগে এক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সভাপতিত্ব করেন প্রবীণ রাজনৈতিক কর্নেল শওকত। শুভেচ্ছা অতিথি থাকলেন আমাদের আজকের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। আমাকে সেদিন আশাতীত অবস্থানে বরিত করা করা হয়। সাবেক ডি. জি মাওলানা আব্দুল আউয়াল থেকেও আমাকে অনেক বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। যদিও আমি আপত্তি জানিয়েছি। দৈনিক পত্রিকাগুলো সংবাদটি চমৎকারভাবে কভারেজ দিয়েছিল।

সেদিন আমি ১৮৩১ ইং বালাকোট রণাঙ্গন থেকে ১৯৭১ ইং স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত সময়কালে ওলামাদের সংগ্রামী ইতিহাস সবিস্তারে তুলে ধরেছিলাম। পত্রিকার শিরোনাম ছিল ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ইসলাম বিরোধী ছিলনা’ আলোচ্য বিষয় ছিল ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আলেম সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি’। সেদিনকার আমাদের ভূমিকায় আকাবিরে উলামায়ে দেওবন্দের রূহানি শক্তির মদদ প্রত্যক্ষ করেছিলাম। মুরুব্বি ধরা আর মুরুব্বী ছাড়ার পার্থক্যকে স্বচক্ষে দেখেছিলাম। এক দীর্ঘ সময় পক্ষে-বিপক্ষে পত্রিকায় লেখালেখি হয়েছে।

শুরু  হয় নবযুগ। আমি কেন জননেত্রী শেখ হাসিনার সাথে প্রেসক্লাবে একত্রিত হলাম। এই জন্য আমার পূর্ববর্তী প্রতিষ্ঠান আমার বিরুদ্ধে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করে। পরিশেষে এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯১ ইং বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর একসাথে বলতে গেলে এক দিনে আমার তিনটি চাকুরি চলে যায়। মাদরাসা শিক্ষকতা, মসজিদের ইমামতি এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশন-এর সাময়িক লেখালেখির সুযোগ-সুবিধা। আমাদের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা এবং প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা মুজাফফর হোসেন পল্টুসহ অনেক নেতাই বিষয়টি সম্পর্কে ওয়াকিফ ছিলেন।

অসহনীয় অগ্নিপরীক্ষায় ভেঙ্গে যাইনি। মজলুমের দয়াময় মালিক আল্লাহ ভেঙ্গে যেতে দেননি। লেখা লেখি রাস্তায়, এখন বৃষ্টির ন্যায় ঘাম ঝরছে। রাস্তায় প্রচন্ড জ্যাম। সেই ত্যাগের সময়কার কথাগুলো লিখছি আবার ত্যাগের ভেতর দিয়ে। ওলামায়ে কিরাম জাতির হৃদয়তুল্য। তারা উঠুক, তারা ফুটুক এই প্রত্যাশায় আজও ব্যস্ততায় আছি। প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন অঙ্গনে উলামাদের প্রতি জেনারেল শিক্ষিতদেরকে আকৃষ্ট করার জন্য কর্মসূচি চালিয়ে এসেছি। এরই ধারাবাহিকতায় কওমী শিক্ষা সনদের স্বীকৃতি। দুনিয়াবী, বৈষয়িক স্বার্থে নয় এই উদ্যোগ। ইংরেজি শিক্ষিত আর আরবী শিক্ষিতরা হোক ভাই ভাই, তাছাড়া আর তেমন কিছু নেই। সমাজে দেখুক মেধাবী নীতিবান আরো আছে।

সনদের স্বীকৃতি প্রদানের ঐতিহাসিক দিনে ১১/৪/২০১৭ ইং গণভবনে আল্লামা ফরিদ উদ্দিন মাসুদ সাহেব, আল্লামা আহমদ শফী রহমাতুল্লাহ আলাই ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সামনে উচ্চস্বরের ওলামাদের উপস্থিতিতে তার বক্তব্যে আমাদের সেই কনফারেন্সের ইঙ্গিত দিয়ে কথা শুরু করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন ১৯৮৮ ইং এ  নেন্ত্রীর সাথে জাতীয় প্রেসক্লাবে প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে যেই যাত্রা শুরু হয়েছিল এর ফলশ্রুতিতে আজকের এই পরিবেশের আগমনী। পক্ষান্তরে আল্লামা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ ছিলেন সেই উদ্যোগের সাথে সম্পৃক্ত অন্যতম ব্যক্তিত্ব।

কওমী মাদরাসা শিক্ষার সর্বোচ্চ ক্লাস দাওরা হাদিস। এই দাওরায়ে হাদীসের সনদকে মাস্টার্স (ইসলামী স্টাডিজ-আরবী সাহিত্য) সমমান ঘোষণা দিয়ে জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কি উপহারটি প্রদান করলেন তা উপলব্ধির সময় এখনো হয়নি। এই সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপের জন্য তার সরকার ষোলোকলা উন্নয়নের স্বাক্ষর রাখলেন।

কওমী মাদরাসা শেকড় কতটুকু গভীরে বঙ্গবন্ধুর কন্যা তা টের পেয়ে প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন এর ফলাফল শুরু হয়ে গেছে। আমার এই সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধে বেশী কিছু বলার সুযোগ নেই। তবে এটুকু বলে রাখি কওমী সনদের স্বীকৃতির দাবি ১৯৯৬ ইং এর আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে উত্থাপিত হয়েছিল। শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে কিরামের নিকট আমরা শরণাপন্ন হয়ে এই দাবীকে গণদাবীতে পরিণত করেছি। শীর্ষ নেতাদের আমরা আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেছি।

তবে অর্জন যেনো বিসর্জনের শিকার না হয়, চৌকান্না থাকতে থাকতে হবে সবাইকে সমভাবে। সাহায্য চাইতে হবে আল্লাহর কাছে। নবাগত অনুপ্রবেশকারী চক্র থেকে যারা সাবধান থাকেনি, তারা জাতির কাছে ধরা খেয়েছে। নবাগত হাইব্রিডরা সারাটা দুনিয়াকে জ্বালাচ্ছে। আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন।

কওমী অঙ্গন একটি নাযুক অঙ্গন। কেউ কাউকে ছাড় দেয়ার নয়। কওমী মাদরাসা দ্বীনি ঐতিহ্যকে নিয়ে কোনো প্রকার তালবাহানা সহ্য করা হবে না। আমরা বহু ঝুঁকি নিয়ে এই দাবী উত্থাপন করেছি। শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ. সৈয়দ মুহাম্মাদ ফজলুল করিম পীর সাহেব চরমোনাই রহমাতুল্লাহ আলাইসহ বহু বরেণ্য উলামায়ে কিরাম এর অতুলনীয় অবদান রয়েছে এই সনদের স্বীকৃতির বিষয়ে। আমরা যদি নিজেই কওমী মাদরাসা ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে না পারি তাহলে সবকিছু গুড়েবালিতে পরিণত হবে। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করেনি। করবেও না।

আজ হয়তো আমরা বিশাল এক বটবৃক্ষের ছায়ায় আছি। ইতিপূর্বেও ছিলাম। বিশ্ব উলামাকুল শিরোমনি আল্লামা আহমদ শফী রহমতুল্লাহি আলাই ছিলেন। আমরা তার ছায়ায় টিকে ছিলাম তার রুহানি পরশে। স্বচ্ছ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আমাদেরকে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। এখানে জাগতিক শুকনো নেতৃত্বের কিছুই নেই। আমানত ও আদালতের সাথে আঞ্জাম দিতে হবে সব কর্মকাণ্ড। লক্ষণ কিন্তু কেমন কেমন। আবার বলে রাখি যদি স্বচ্ছতার অভাব দেখা দেয় তাহলে ফলাফল কিন্তু ভালো হয় না কখনো। পাকিস্তান আন্দোলনের দশা দেখা দিবে। ইখলাস যেনো মাশকের বিষয় না হয়, বরং আমলি হয়। কিছু পাওয়া না পাওয়ার ফরিয়াদ নয়। ভবিষ্যৎ সুন্দরের জন্য কেবল এজমালি প্রস্তাবলী দেয়া হলো।

মহান আল্লাহর দরবারে দোয়া করি লেখাটির জন্য সবিস্তারে আবার বড় প্রবন্ধাকারে যুক্তিগ্রাহ্য করে পরিবেশন পরিবেশনের প্রয়োজন না হয়।

আমি বর্তমান কওমী প্রজন্মের একান্ত প্রত্যাশা, অতীতের আকাবিরে দেওবন্দ রহমতুল্লাহি আলাই ও আকাবিরে হাটহাজারী রহমতউল্লাহি আলাই এর লালিত আক্বীদা, তালীম ও আদর্শকে শতভাগ হেফাজত করে যুগোপযোগী চিন্তা-চেতনার আলোকে উলামায়ে হক্কানীর এই কাফেলা মহান আল্লাহমূখী, শেষ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নতরূপী গতিতে চলবে অব্যাহতভাবে। এতে কোন নমনীয়তা নেই। জিদ্দাত জরুরত হলেও কাদামত-ই হোক চূড়ান্ত গায়াত। যা কিতাবুল্লাহ’ ও রিজালুল্লাহ’ সমন্বিত প্রয়াস। যা আমাদের মাশায়েখদের সার্বক্ষণিক সবক।

বর্তমান কওমী মাদরাসা পরিধি বৃদ্ধি পেয়েছে। দায়িত্ব বেড়েছে। সে অনুযায়ী কর্মকাণ্ডের গতিও বৃদ্ধি পেতে হবে। প্রতিটি সমৃদ্ধি ও সহযোগিতার অঙ্গনে অঘোষিতভাবে দুটি জিনিষের অনুপ্রবেশ ঘটে। একটি প্রতিযোগিতা অপরটি প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এজন্য প্রয়োজন গঠনমূলক শিক্ষাদীক্ষা ও সুচিন্তিত প্রশিক্ষণের। স্বীকৃতি পেয়ে গতানুগতিকভাবে ঘুমিয়ে পড়লে চলবেনা। সচেতন, সজাগ দৃষ্টি ও দূরদৃষ্টি না থাকলে জাতীয় বদনামি থেকে রেহাই পাওয়ার পথ থাকবে না। ভাষা-সাহিত্য, যুগোপযোগী চিন্তা-চেতনা, গবেষণাধর্মী পাঠদান ও পাঠগ্রহণ সবকিছু নিয়ে সামনে বাড়ার বিকল্প নেই। আমাদের সিলেবাস বদলাতে হবে আমি এটা বলছি না। তালীমী তায়াল্লুমী মান আরো বৃদ্ধি করতে হবে। হিদায়া গ্রন্থকারের হৃদয় নিংড়ানো ভূমিকা ভাষ্যটি রীতিমতো পুনঃদৃষ্টি দিতে হবে। আমাদের আকাবিরে দেওবন্দ, আকাবিরে হাটহাজারীর দূরদৃষ্টির ওয়ারিশ হতে হবে আমাদেরকে। তাদের উলুম ও ফুনূনের সুযোগ্য উত্তরসুরী হতে হবে আমাদেরকে। কেবল জাগতিক উন্নয়ন ও উত্তরণ মুখী ভূমিকায় সব তছনছ হয়ে যাবে। কওমী সনদের স্বীকৃতি পেয়ে গেছি, এটা বড় কথা নয়। আমরা জাতীয় খিদমতের লক্ষ্যে কতটুকু প্রস্তুতি নিচ্ছি? জাতিকে কি দিচ্ছি? আমাদের গৃহিত ব্যবস্থাপনার মান কতটুকু? আমাদের গৃহীত কর্মসূচিতে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় অভিনবত্ব কেমন? দেখার বিষয়ে আরো কিছু? উল্লেখ্য ১৯৯৯ ইং সনদের স্বীকৃতির দাবি উত্থাপন করার পর প্রায় বছরই জামিয়াতুস সাহাবা ঢাকা থেকে প্রকাশিত ডায়েরিতে লেখা থাকতো “কওমী সনদের স্বীকৃতি দিবে যে সরকার, কওমী মাদরাসা ওলারাও সে সরকারকে নিজেদের সরকার বলে স্বীকৃতি দিবে। এই দাবি সর্বাগ্রে উত্থাপনকারী জামিয়াতুস সাহাবাহ এই অঙ্গীকার অক্ষুন্ন রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। জোট সরকারের আমলেও (২০০১-২০০৬) টেন্ডারটি অনুরূপই থাকতো। সৌভাগ্যের বিষয় স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময়োপযোগী হস্তক্ষেপ ও আন্তরিকতায় কওমী মাদরাসা শিক্ষা সনদের স্বীকৃতি প্রাপ্ত হয়। তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ছোট করতে চাইনি। সবাই মিলে দোয়া করি নিগৃহীত, অবহেলিতদের মাথায় রাজমুকুট বসানোর তাদের চিরাচরিত প্রয়াসটি চির অব্যাহত থাকুক। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বরিত হোক সফল উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে। সাথে সাথে দোয়া করি বিশ্ব উলামাকূল শিরমনি আল্লামা আহমদ শফী রহমাতুল্লাহ আলাই ঐক্যের প্রাণপুরুষ হিসেবে মহান আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতের উঁচা মাকাম দান করুন। আমীন।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

আমরা জাতীয় খিদমতের লক্ষ্যে কতটুকু প্রস্তুতি নিচ্ছি?

কওমী সনদ স্বীকৃতির ইতিকথা 

আপডেট সময় : ০৪:১৩:৩৮ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৪ জুন ২০২৩

শাইখুল হাদীস রুহুল আমীন খাঁন উজানী

-প্রিন্সিপাল জামিয়াতুস সাহাব ঢাকা

২০১৭ ইং সালটি কওমী মাদরাসা ইতিহাসে এক স্মরণীয় বছর। বহু চড়াই-উতরাই পার হয়ে শেষ পর্যন্ত কওমী মাদরাসা শিক্ষা সনদের সরকারি স্বীকৃতি বর্তমান প্রজন্মের জন্য কিছু কথা সংক্ষেপে বলে রাখা প্রয়োজন।

আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে যখন ক্ষমতায় আসে আমাদের উজানির মরহুম মাওলানা আব্দুল আউয়াল সাহেবকে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজি করা হয়। আমাকে করা হলো ইসলামিক ফাউন্ডেশন-এর বোর্ড অব গভর্নর সদস্য। ফাউন্ডেশন একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেশের সর্বস্তরের জনতার সাথে আমাদের স্বাভাবিকভাবে সম্পর্ক হবার সুবাদে একটি বিষয় আমার দৃষ্টি কাড়ে, দাগ কাটে। তা হচ্ছে কওমী মাদরাসা অঙ্গন থেকে ইসলামিক ফাউন্ডেশনে কাউকে কোন চাকরি দেয়ার ব্যবস্থা না থাকা। যেহেতু তাদের সার্টিফিকেট নেই।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে সুদূর প্রসারী লক্ষ্য নিয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এর অন্যতম একটি হলো ইসলামের অগ্রণী মনীষীদের লেখা আরবী, ফার্সি ও উর্দু ইত্যাদি গ্রন্থাবলী মাতৃ ভাষায় অনুবাদ করে বাংলা ভাষা-ভাষীদের কাছে পরিবেশন করা, এবং মদীনার খাটি ইসলামের রূপটি সাধারণ মুসলমানদের সামনে পেশ করা। আল্লাহর মেহেরবানীতে সেই লক্ষ্যে ইসলামিক ফাউন্ডেশন শুরু থেকে বহু সফলকাম হয়ে আসছে। এর দ্বারা বাংলা ভাষা ও সাহিত্য হয়েছে যথেষ্ট সমৃদ্ধশালী। দেশের সিংহভাগ শিক্ষিত মানুষ এখনো জানতে পারেনি বা পেরে উঠেনি এই কাজ কারা করেছে? এদিকে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উত্তোরণের পরিমাণ কতটুকু বিশেষ করে মাতৃভাষা চর্চায় এই প্রতিষ্ঠান কতটুকু অগ্রণী। অথচ মাতৃভাষায় ভাষান্তরের ক্ষেত্রে কওমী ওলামায়ে কিরাম মাতৃভাষা সাহিত্য সেবায় এত শীর্ষে থাকা সত্ত্বেও এবং দেশের বরেণ্য শিক্ষিতদের শিক্ষাগুরু হওয়া সত্ত্বেও তাদের জায়গা হচ্ছে নিরক্ষরদের জীর্ণ তালিকায়।

পবিত্র কোরআন ও হাদিস গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে হাজার হাজার পৃষ্ঠা গ্রন্থ যারা প্রকাশ করেছেন এবং করাচ্ছেন তারা আছেন মূর্খদের অবহেলিত কাতারে। আমি তখন ভাবতাম স্বয়ং সক্রেটিস আর এরিস্টোটল যদি থাকতেন তাদের নাম হয়তো কওমীদের সাথেই মূর্খদের কাতারে থাকতো। কেননা তারা তো গতানুগতিক স্কুল, হাইস্কুল, কলেজ, মাদরাসা-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নয়।

এক কথায় এই মূর্খতার ট্রেডমার্ক থেকে কওমী শিক্ষিতদের পরিত্রাণের জন্য মাঠে নেমে গেলাম। মরহুম মাওলানা আব্দুল আউয়াল সাহেব সহ শীর্ষ ব্যক্তিবর্গের নিকট বেশী বেশী দৌড়াতে লাগলাম। সাথে রাখতাম অধ্যক্ষ সৈয়দ মাওলানা ওহীদুজ্জামান সাহেব, মাওলানা রিয়াজুল ইসলাম মনির, অধ্যক্ষ মাসুদুর রহমান বিক্রমপুরীদেরকে। একপর্যায়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তদানীন্তন রাজনৈতিক উপদেষ্টা ডক্টর আব্দুল মালেকের সাথে আমাদের বৈঠক হয়। সরকারি পর্যায়ে মোটামুটি সাড়া পড়ে গেছে।

পরিশেষে হাজার ১৯৯৯ সালের ১৩ ই মার্চ জাতীয় প্রেসক্লাবে ভিআইপি লাউঞ্জে ওলামা-মাশায়েখদের সভাপতি হিসেবে আমার সভাপতিত্বে সর্বপ্রথম মাদরাসা শিক্ষা সনদের সরকারি স্বীকৃতির দাবিতে প্রেস কনফারেন্স করে দেশের আলেম-ওলামা ও সূধীজন এতে অংশগ্রহণ করেন

প্রথম সারির দৈনিক পত্রিকাগুলো আন্তরিকতার সাথে আকর্ষণীয় শিরোনামে সংবাদটি কভারেজ করে। বাম পত্রিকাগুলোও কোনো কার্পণ্য করেনি বরং খুবই চমৎকার ভাবে ফলাও করে। আমি অতীতে বহুবার দেখেছি মানবতার স্বপক্ষের যৌক্তিক দাবি উত্থাপন করলে আমাদের গৃহপালিত বন্ধুরা পিছুটান দেয়। তাই দেখেছি সদিচ্ছা-কল্যাণকামিতার সাদামাটা কর্মকাণ্ডের এ্যাকশন যে অকল্পনীয় প্রত্যক্ষ করেছি জীবনে শতবার। এবারও করলাম। এই দাবি উত্থাপন করার পর দেশের অনেক উলামার কাছে ধিকৃত হয়েছি। কওমী মাদরাসা স্বীকৃতি চাইতে গিয়ে নিজের যেন স্বীকৃতি হারা হয়েছি। স্বীকৃতি হারা হয়েছে মাদরাসাগুলো। কলেজ করার চক্রান্তে নাকি আমি অবতীর্ণ হয়েছি। আল্লাহ আমাদের সকলকে মাফ করুন। আমাকে তখন বলা হতো যাদের জন্য স্বীকৃতি চান, তারা তো আপনাকে প্রত্যাখ্যান করবে। আমি জবাব দিলাম কোন অসুবিধা নেই। ফল পাকলে গাছ ফলকে ছেড়ে দেয়, এটাই স্বাভাবিক।  কেউ ত্যাগে শান্ত কেউ ভোগে।

আরেকটি কথা উল্লেখ না করলেই নয়, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে স্বাধীনতার পর বিভিন্ন প্রচার মাধ্যম অপপ্রচারের মাধ্যমে উলামায়ে কিরামকে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিপক্ষ চিহ্নিত করার জন্য দুইটা মহল সোচ্চার ছিল। উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর পাঁয়তারা করছিল। যার দুঃখজনক পরিণতি দাঁড়িয়েছিল আলেম-ওলামা বললেই মনে করা হতো রাজাকার-আলবদর। বিষয়টি কিন্তু সম্পূর্ণ ষড়যন্ত্রমূলক। এটা আমাকে ও আমাদেরকে দারুণভাবে ব্যথিত করে তোলেছিল।

আমরা গুটিকয়েকজন বিষয়টি নিয়ে ভাবতাম। এ ভাবনার ফলশ্রুতিতে ১০ জুলাই ১৯৮৮ ইং জাতীয় প্রেসক্লাবে মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদ ও মুক্তিযুদ্ধা সংগ্রাম পরিষদের যৌথ উদ্যোগে এক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সভাপতিত্ব করেন প্রবীণ রাজনৈতিক কর্নেল শওকত। শুভেচ্ছা অতিথি থাকলেন আমাদের আজকের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। আমাকে সেদিন আশাতীত অবস্থানে বরিত করা করা হয়। সাবেক ডি. জি মাওলানা আব্দুল আউয়াল থেকেও আমাকে অনেক বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। যদিও আমি আপত্তি জানিয়েছি। দৈনিক পত্রিকাগুলো সংবাদটি চমৎকারভাবে কভারেজ দিয়েছিল।

সেদিন আমি ১৮৩১ ইং বালাকোট রণাঙ্গন থেকে ১৯৭১ ইং স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত সময়কালে ওলামাদের সংগ্রামী ইতিহাস সবিস্তারে তুলে ধরেছিলাম। পত্রিকার শিরোনাম ছিল ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ইসলাম বিরোধী ছিলনা’ আলোচ্য বিষয় ছিল ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আলেম সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি’। সেদিনকার আমাদের ভূমিকায় আকাবিরে উলামায়ে দেওবন্দের রূহানি শক্তির মদদ প্রত্যক্ষ করেছিলাম। মুরুব্বি ধরা আর মুরুব্বী ছাড়ার পার্থক্যকে স্বচক্ষে দেখেছিলাম। এক দীর্ঘ সময় পক্ষে-বিপক্ষে পত্রিকায় লেখালেখি হয়েছে।

শুরু  হয় নবযুগ। আমি কেন জননেত্রী শেখ হাসিনার সাথে প্রেসক্লাবে একত্রিত হলাম। এই জন্য আমার পূর্ববর্তী প্রতিষ্ঠান আমার বিরুদ্ধে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করে। পরিশেষে এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯১ ইং বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর একসাথে বলতে গেলে এক দিনে আমার তিনটি চাকুরি চলে যায়। মাদরাসা শিক্ষকতা, মসজিদের ইমামতি এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশন-এর সাময়িক লেখালেখির সুযোগ-সুবিধা। আমাদের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা এবং প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা মুজাফফর হোসেন পল্টুসহ অনেক নেতাই বিষয়টি সম্পর্কে ওয়াকিফ ছিলেন।

অসহনীয় অগ্নিপরীক্ষায় ভেঙ্গে যাইনি। মজলুমের দয়াময় মালিক আল্লাহ ভেঙ্গে যেতে দেননি। লেখা লেখি রাস্তায়, এখন বৃষ্টির ন্যায় ঘাম ঝরছে। রাস্তায় প্রচন্ড জ্যাম। সেই ত্যাগের সময়কার কথাগুলো লিখছি আবার ত্যাগের ভেতর দিয়ে। ওলামায়ে কিরাম জাতির হৃদয়তুল্য। তারা উঠুক, তারা ফুটুক এই প্রত্যাশায় আজও ব্যস্ততায় আছি। প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন অঙ্গনে উলামাদের প্রতি জেনারেল শিক্ষিতদেরকে আকৃষ্ট করার জন্য কর্মসূচি চালিয়ে এসেছি। এরই ধারাবাহিকতায় কওমী শিক্ষা সনদের স্বীকৃতি। দুনিয়াবী, বৈষয়িক স্বার্থে নয় এই উদ্যোগ। ইংরেজি শিক্ষিত আর আরবী শিক্ষিতরা হোক ভাই ভাই, তাছাড়া আর তেমন কিছু নেই। সমাজে দেখুক মেধাবী নীতিবান আরো আছে।

সনদের স্বীকৃতি প্রদানের ঐতিহাসিক দিনে ১১/৪/২০১৭ ইং গণভবনে আল্লামা ফরিদ উদ্দিন মাসুদ সাহেব, আল্লামা আহমদ শফী রহমাতুল্লাহ আলাই ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সামনে উচ্চস্বরের ওলামাদের উপস্থিতিতে তার বক্তব্যে আমাদের সেই কনফারেন্সের ইঙ্গিত দিয়ে কথা শুরু করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন ১৯৮৮ ইং এ  নেন্ত্রীর সাথে জাতীয় প্রেসক্লাবে প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে যেই যাত্রা শুরু হয়েছিল এর ফলশ্রুতিতে আজকের এই পরিবেশের আগমনী। পক্ষান্তরে আল্লামা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ ছিলেন সেই উদ্যোগের সাথে সম্পৃক্ত অন্যতম ব্যক্তিত্ব।

কওমী মাদরাসা শিক্ষার সর্বোচ্চ ক্লাস দাওরা হাদিস। এই দাওরায়ে হাদীসের সনদকে মাস্টার্স (ইসলামী স্টাডিজ-আরবী সাহিত্য) সমমান ঘোষণা দিয়ে জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কি উপহারটি প্রদান করলেন তা উপলব্ধির সময় এখনো হয়নি। এই সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপের জন্য তার সরকার ষোলোকলা উন্নয়নের স্বাক্ষর রাখলেন।

কওমী মাদরাসা শেকড় কতটুকু গভীরে বঙ্গবন্ধুর কন্যা তা টের পেয়ে প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন এর ফলাফল শুরু হয়ে গেছে। আমার এই সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধে বেশী কিছু বলার সুযোগ নেই। তবে এটুকু বলে রাখি কওমী সনদের স্বীকৃতির দাবি ১৯৯৬ ইং এর আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে উত্থাপিত হয়েছিল। শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে কিরামের নিকট আমরা শরণাপন্ন হয়ে এই দাবীকে গণদাবীতে পরিণত করেছি। শীর্ষ নেতাদের আমরা আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেছি।

তবে অর্জন যেনো বিসর্জনের শিকার না হয়, চৌকান্না থাকতে থাকতে হবে সবাইকে সমভাবে। সাহায্য চাইতে হবে আল্লাহর কাছে। নবাগত অনুপ্রবেশকারী চক্র থেকে যারা সাবধান থাকেনি, তারা জাতির কাছে ধরা খেয়েছে। নবাগত হাইব্রিডরা সারাটা দুনিয়াকে জ্বালাচ্ছে। আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন।

কওমী অঙ্গন একটি নাযুক অঙ্গন। কেউ কাউকে ছাড় দেয়ার নয়। কওমী মাদরাসা দ্বীনি ঐতিহ্যকে নিয়ে কোনো প্রকার তালবাহানা সহ্য করা হবে না। আমরা বহু ঝুঁকি নিয়ে এই দাবী উত্থাপন করেছি। শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ. সৈয়দ মুহাম্মাদ ফজলুল করিম পীর সাহেব চরমোনাই রহমাতুল্লাহ আলাইসহ বহু বরেণ্য উলামায়ে কিরাম এর অতুলনীয় অবদান রয়েছে এই সনদের স্বীকৃতির বিষয়ে। আমরা যদি নিজেই কওমী মাদরাসা ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে না পারি তাহলে সবকিছু গুড়েবালিতে পরিণত হবে। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করেনি। করবেও না।

আজ হয়তো আমরা বিশাল এক বটবৃক্ষের ছায়ায় আছি। ইতিপূর্বেও ছিলাম। বিশ্ব উলামাকুল শিরোমনি আল্লামা আহমদ শফী রহমতুল্লাহি আলাই ছিলেন। আমরা তার ছায়ায় টিকে ছিলাম তার রুহানি পরশে। স্বচ্ছ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আমাদেরকে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। এখানে জাগতিক শুকনো নেতৃত্বের কিছুই নেই। আমানত ও আদালতের সাথে আঞ্জাম দিতে হবে সব কর্মকাণ্ড। লক্ষণ কিন্তু কেমন কেমন। আবার বলে রাখি যদি স্বচ্ছতার অভাব দেখা দেয় তাহলে ফলাফল কিন্তু ভালো হয় না কখনো। পাকিস্তান আন্দোলনের দশা দেখা দিবে। ইখলাস যেনো মাশকের বিষয় না হয়, বরং আমলি হয়। কিছু পাওয়া না পাওয়ার ফরিয়াদ নয়। ভবিষ্যৎ সুন্দরের জন্য কেবল এজমালি প্রস্তাবলী দেয়া হলো।

মহান আল্লাহর দরবারে দোয়া করি লেখাটির জন্য সবিস্তারে আবার বড় প্রবন্ধাকারে যুক্তিগ্রাহ্য করে পরিবেশন পরিবেশনের প্রয়োজন না হয়।

আমি বর্তমান কওমী প্রজন্মের একান্ত প্রত্যাশা, অতীতের আকাবিরে দেওবন্দ রহমতুল্লাহি আলাই ও আকাবিরে হাটহাজারী রহমতউল্লাহি আলাই এর লালিত আক্বীদা, তালীম ও আদর্শকে শতভাগ হেফাজত করে যুগোপযোগী চিন্তা-চেতনার আলোকে উলামায়ে হক্কানীর এই কাফেলা মহান আল্লাহমূখী, শেষ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নতরূপী গতিতে চলবে অব্যাহতভাবে। এতে কোন নমনীয়তা নেই। জিদ্দাত জরুরত হলেও কাদামত-ই হোক চূড়ান্ত গায়াত। যা কিতাবুল্লাহ’ ও রিজালুল্লাহ’ সমন্বিত প্রয়াস। যা আমাদের মাশায়েখদের সার্বক্ষণিক সবক।

বর্তমান কওমী মাদরাসা পরিধি বৃদ্ধি পেয়েছে। দায়িত্ব বেড়েছে। সে অনুযায়ী কর্মকাণ্ডের গতিও বৃদ্ধি পেতে হবে। প্রতিটি সমৃদ্ধি ও সহযোগিতার অঙ্গনে অঘোষিতভাবে দুটি জিনিষের অনুপ্রবেশ ঘটে। একটি প্রতিযোগিতা অপরটি প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এজন্য প্রয়োজন গঠনমূলক শিক্ষাদীক্ষা ও সুচিন্তিত প্রশিক্ষণের। স্বীকৃতি পেয়ে গতানুগতিকভাবে ঘুমিয়ে পড়লে চলবেনা। সচেতন, সজাগ দৃষ্টি ও দূরদৃষ্টি না থাকলে জাতীয় বদনামি থেকে রেহাই পাওয়ার পথ থাকবে না। ভাষা-সাহিত্য, যুগোপযোগী চিন্তা-চেতনা, গবেষণাধর্মী পাঠদান ও পাঠগ্রহণ সবকিছু নিয়ে সামনে বাড়ার বিকল্প নেই। আমাদের সিলেবাস বদলাতে হবে আমি এটা বলছি না। তালীমী তায়াল্লুমী মান আরো বৃদ্ধি করতে হবে। হিদায়া গ্রন্থকারের হৃদয় নিংড়ানো ভূমিকা ভাষ্যটি রীতিমতো পুনঃদৃষ্টি দিতে হবে। আমাদের আকাবিরে দেওবন্দ, আকাবিরে হাটহাজারীর দূরদৃষ্টির ওয়ারিশ হতে হবে আমাদেরকে। তাদের উলুম ও ফুনূনের সুযোগ্য উত্তরসুরী হতে হবে আমাদেরকে। কেবল জাগতিক উন্নয়ন ও উত্তরণ মুখী ভূমিকায় সব তছনছ হয়ে যাবে। কওমী সনদের স্বীকৃতি পেয়ে গেছি, এটা বড় কথা নয়। আমরা জাতীয় খিদমতের লক্ষ্যে কতটুকু প্রস্তুতি নিচ্ছি? জাতিকে কি দিচ্ছি? আমাদের গৃহিত ব্যবস্থাপনার মান কতটুকু? আমাদের গৃহীত কর্মসূচিতে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় অভিনবত্ব কেমন? দেখার বিষয়ে আরো কিছু? উল্লেখ্য ১৯৯৯ ইং সনদের স্বীকৃতির দাবি উত্থাপন করার পর প্রায় বছরই জামিয়াতুস সাহাবা ঢাকা থেকে প্রকাশিত ডায়েরিতে লেখা থাকতো “কওমী সনদের স্বীকৃতি দিবে যে সরকার, কওমী মাদরাসা ওলারাও সে সরকারকে নিজেদের সরকার বলে স্বীকৃতি দিবে। এই দাবি সর্বাগ্রে উত্থাপনকারী জামিয়াতুস সাহাবাহ এই অঙ্গীকার অক্ষুন্ন রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। জোট সরকারের আমলেও (২০০১-২০০৬) টেন্ডারটি অনুরূপই থাকতো। সৌভাগ্যের বিষয় স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময়োপযোগী হস্তক্ষেপ ও আন্তরিকতায় কওমী মাদরাসা শিক্ষা সনদের স্বীকৃতি প্রাপ্ত হয়। তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ছোট করতে চাইনি। সবাই মিলে দোয়া করি নিগৃহীত, অবহেলিতদের মাথায় রাজমুকুট বসানোর তাদের চিরাচরিত প্রয়াসটি চির অব্যাহত থাকুক। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বরিত হোক সফল উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে। সাথে সাথে দোয়া করি বিশ্ব উলামাকূল শিরমনি আল্লামা আহমদ শফী রহমাতুল্লাহ আলাই ঐক্যের প্রাণপুরুষ হিসেবে মহান আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতের উঁচা মাকাম দান করুন। আমীন।