০৩:১১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২০ জুন ২০২৫, ৫ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
ভোলা-বরিশাল সেতুর দাবিতে মানববন্ধন ভোলা জেলা ওলামা তলাবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বিলুপ্ত করায় বিমানবন্দরে এফবিসিসিএফএএ’র সংবাদ সম্মেলন ক্যারিয়ার বাংলাদেশের গোল টেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত দলিপাড়া ও দেশবাসীকে ঈদ-উল-ফিতরের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন আবু জাফর আলম উত্তরা ১১ নং সেক্টর ও দেশবাসীকে ঈদ-উল-ফিতরের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন অধ্যক্ষ সালাউদ্দিন ভূঁইয়া সেই গুলিবিদ্ধ ইমরান কে দেখতে গেলেন লুৎফুজ্জামান বাবর একাত্তরের ন্যায় ২৪ যোদ্ধারাও পাবে সকল সুবিধা-মুস্তাফিজ সেগুন গুম-খুনের শিকার ও চব্বিশের শহীদ পরিবারকে ঈদ উপহার দিলেন বিএনপি নেতা আমিনুল হক জাতিসঙ্ঘ শূন্য বর্জ্য দিবসে প্রফেসর ইউনূসকে অভিনন্দন জানালেন তুরস্কের ফার্স্ট লেডি চীনা বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার

পলাশীর ইতিহাস

পলাশীর ট্র্যাজেডী, ইউরোপের কাছে এশিয়ার পরাজয়

ইসলাম ডেস্ক :
  • আপডেট সময় : ০৩:৫৭:৫৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ২১ জুন ২০২৩ ৭৯ বার পড়া হয়েছে
ভয়েস অব টাইম অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

 – মোঃ মাছউদুর রহমান

২৩ জুন ঐতিহাসিক পলাশী ট্রাজেডি দিবস। এটি বাঙালির ইতিহাসে এক কালো অধ্যায়। ২৬৬ বছর আগে ১৭৫৭ সালের এই দিনে ভাগীরথী তীরে পলাশীর আম বাগানে ইংরেজদের সঙ্গে এক প্রহসনের যুদ্ধে বাংলা বিহার ও উড়িষ্যার নবাব সিরাজ উদ্দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে অস্তমিত হয় বাংলার স্বাধীনতার শেষ সূর্য। অবসান হয় ভারত বর্ষে মুসলিম শাসনের। মীরজাফর-ঘষেটি বেগমরা সেই প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের কুশীলব। পলাশী দিবস উদযাপনে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠন কর্মসূচি দিয়ে থাকলেও এর থেকে শিক্ষা নেয়নি অনেকেই।

প্রহসনের ঐ যুদ্ধে পরাজয়ের পর নবাবের বেদনাদায়ক মৃত্যু হলেও উপমহাদেশের মানুষ নবাবকে আজও শ্রদ্ধা জানায়। তার সঙ্গে যারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল তাদের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। পক্ষান্তরে মীরজাফর আজ বেঈমানের প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ঘৃণিত এই নামটি কোন মা-বাবাই সন্তানের জন্য রাখতে চান না।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, নবাবের সেনাবাহিনীর তুলনায় ইংরেজদের সেনা সংখ্যা ছিল অনেক কম। সেখানে বিশ্বাসঘাতকতা না হলে নবাবের বিজয় ছিল সুনিশ্চিত। নবাব ষড়যন্ত্রকারীদের গোপন ষড়যন্ত্রের কথা জানার পর যদি মীর জাফরকে বন্দী করতেন, তবে অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারী ভয় পেয়ে যেত এবং ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হলে পলাশীর যুদ্ধ হতো না।

ইতিহাসবিদ মোবাশ্বের আলী তার ‘বাংলাদেশের সন্ধানে’ গ্রন্থে লিখেছেন, নবাব সিরাজউদ্দৌলা প্রায় এক লাখ সেনা নিয়ে ক্লাইভের স্বল্পসংখ্যক সেনার কাছে পরাজিত হন মীর জাফরের মোনাফেকিতে।

বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাব আলিবর্দী খাঁ মৃত্যুর আগে দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলাকে নবাবের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী করে যান। নবাব আলিবর্দী খাঁর মৃত্যুর পর ১৭৫৬ সালের এপ্রিল মাসে সিরাজউদ্দৌলা সিংহাসনে বসেন। নবাবের খালা ঘোষেটি বেগম তার ছেলেকে উত্তরাধিকারী না বানানোর কারণে ইংরেজদের সাথে হাত মেলান। সেনাপতি মীর জাফর আলী খান, ধনকুবের জগৎ শেঠ, রাজা রায় দুর্লভ, উমিচাঁদ, ইয়ার লতিফ প্রমুখ ইংরেজদের সাথে ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠেন। ধূর্ত ইংরেজরা সন্ধির চুক্তি ভঙ্গ করে চন্দন নগরের ফরাসিদের দুর্গ দখল করে নেয়।

এরপর ১৭৫৭ সালের ১৭ জুন ক্লাইভ কাটোয়ায় অবস্থান নেয়। নবাব ২২ জুন ইংরেজদের আগেই পলাশী পৌঁছে শিবির স্থাপন করেন। ২৩ জুন সকাল ৮টায় যুদ্ধ শুরু হয়। কিন্তু প্রধান সেনাপতি মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় নবাবের পরাজয় ঘটে।

ট্র্যাজেডী বলার কারণ :

পলাশীর এই ঘটনা যুদ্ধ না-বলে একে ট্র্যাজেডি বা বিপর্যয় বলাই অধিকতর যুক্তিসঙ্গত। কেননা যুদ্ধ করে জয় পরাজয় এক কথা। আর যুদ্ধ না-করে যে পরাজয় বরণ করা সম্পূর্ণ ভিন্ন। অনেকে একে যুদ্ধ না-বলে `ষড়যন্ত্রের কালো থাবা’ বলে থাকেন। এ নিন্দনীয় প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে একদল লোভী, ষড়যন্ত্রকারী, স্বার্থান্বেষী, দেশদ্রোহী হিন্দু-মুসলিম মিলিত মানুষরা দেশপ্রেমিক নবাব সিরাজউদ্দৌলার মত লোককে পরাজিত ও নিহত করে নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির চেষ্টা করেছিল। তাই পলাশীর ট্রাজেডি না দেখলে হয়তবা পৃথিবীর মানুষ কখনোই জানত না ষড়যন্ত্র কাকে বলে? পলাশীর ঘটনা একটি সাধারণ ঘটনা নয়। এর ভেতরে লুকিয়ে আছে বাংলাসহ এ অঞ্চলের মানুষের ২০০ বছরের পরাধীনতার শিকল। আজকেও তেমন দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা, দেশী-বিদেশী সাম্রাজ্যবাদীদের পা চাটা স্বার্থন্বেষী গোলামদের ষড়যন্ত্রের কারণে হুমকীর মুখোমখি। প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের ন্যায় ইঙ্গ-মার্কিন আগ্রাসন, দিল্লীর বায়বীয় ইশারা, হাওয়া ভবন, গণভবন-বঙ্গভবনের বিদেশ তোষণ বাঙ্গালী জাতিকে ক্ষতবিক্ষত করেছে প্রতিনিয়ত।

পলাশী ট্র্যাজেডী থেকে শিক্ষা : 

নবাব সিরাজউদ্দৌলা সততা, দক্ষতা আর দেশাত্মবোধ নিয়ে ১৪ মাস ১৪ দিন বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা শাসন করেন। মাতামহ (নানা) আলীবর্দী খাঁ শত্রুদের দমন এবং প্রজাদের কল্যাণে তাকে নিয়োজিত করেন এবং সব অন্যায়-অবিচার দূর করার উপদেশ দেন। মাতামহের মৃত্যুশয্যায় সিরাজ পবিত্র কুরআন স্পর্শ করে শপথ করেন দেশ, মাটি ও মানুষের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করবেন। সিরাজকে পরিবারের ভেতরে-বাইরের শত্রুদের ব্যাপক মোকাবেলা করতে হয়। নবাব পদে সিরাজের মনোনয়নে (খালা) ঘসেটি বেগম, রাজবল্লভ, মীরজাফর ও শওকত জং তার প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠে। মুর্শিদাবাদের শাসক শ্রেণী ও প্রভাবশালী মহল প্রথম দিকের নবাবদের সময় ধনসম্পদ কুক্ষিগত করার কাজে নিয়োজিত ছিল। সিরাজ শাসন ক্ষমতায় আরোহণের সাথে সাথে এ গোষ্ঠী আশঙ্কা করে যে, তরুণ নবাব বিপজ্জনক হতে পারে। সিরাজের সিংহাসন লাভ ইংরেজদের জন্য ছিল হুমকিস্বরূপ। কেননা পূর্ববর্তী নবাবদের মতো সিরাজ তাদের অধিকারের অপব্যবহার মেনে নিতে অস্বীকার করেন। চক্রান্তকারীরা ইংরেজদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে মুসলিম জাতিসত্তার কর্তৃত্ব ও নেতৃত্বের পরিবর্তে সাময়িক কায়েমি ও স্বার্থান্বেষী মহলের ক্ষমতা লাভের চেষ্টায় রত ছিল। কিভাবে কোটি কোটি মানুষের গলায় গোলামীর জিঞ্জির পরিয়ে দিয়েছে পলাশীর ঘটনাবলী আমাদের তাই স্মরণ করিয়ে দেয়। কিন্তু ইতিহাসের চরম ট্রাজেডী হচ্ছে কেউ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না। সচেতন দেশপ্রেমিকদেরকে তাই আজ পলাশীর পরিণতিকে সামনে রেখে দেশবাসীকে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের বিরুদ্ধে সোচ্চার করাতে হবে এবং আরেকটি পলাশীর চক্রান্ত থেকে দেশকে রক্ষা করতে হবে। উচ্চাভিলাষী মীর জাফর ও বর্ণবদী হিন্দুদের ষড়যন্ত্রের পলাশী প্রান্তে বাংলার স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়। তাই এ যুগের ঘষেটি বেগম, মীরজাফর ও জগৎশেঠদের দোসরদের কোনভাবে বিশ্বাস করার প্রয়োজন নেই। এটাই পলাশী দিবসের শিক্ষা।

পলাশীর যুদ্ধে পর ধীরে ধীরে সমগ্র উপমহাদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। সিরাজউদ্দৌলার ত্রুটি ছিল তিনি সব প্রতিদ্বন্দী একই সাথে মোকাবেলা করতে চেয়েছিলেন। মুসলিম শাসকরা যতদিন সংস্কৃতির ব্যাপারে সচেতন ছিলেন ততদিন চারদিক থেকে সমৃদ্ধি এসেছে। কিন্তু যখন তারা শুধু সামরিক ও রাজনৈতিক যোগ্যতার ওপর বেশি নির্ভর করেছেন, তখন তাদের ভৌগোলিক স্বাধীনতাও বিপন্ন হয়েছে। স¤্রাট আকবর দীন-ই-ইলাহি নামে এক অদ্ভুত জগাখিচুড়ি ধর্ম প্রচার করেন। ফলে উপমহাদেশে মুসলিম শাসনের পতনের সূচনা হয়। ১৭০৭ সাল থেকেই ভারতবর্ষে মুসলিম শাসন দুর্বল হতে থাকে। জনকল্যাণের পরিবর্তে আরাম-আয়েশে আগ্রহী হয়ে ওঠার ফলে জনগণের সাথে শাসকদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। শত্রুর ব্যাপারে জনগণ সচেতন ছিলেন না। এ কারণে পলাশীর ঘটনার আগে রাষ্ট্রের শক্তি ও সংহতি দুর্বল হয়ে পড়ে। ব্রিটিশ বণিকরা ছিল মুসলিমবিদ্বেষী। আর ব্যবসার আড়ালে এ দেশে তাদের দোসর খুঁজতে থাকে। মুসলমানের দুশমনরাই তাদের নির্ভরযোগ্য বন্ধু হয়ে ওঠে। মুসলিম শাসন ধ্বংস করার জন্য এ দেশের ভেতর একটি শক্তি সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। তারা ছিল চক্রান্তকারী, কিন্তু সাহস কম ছিল। ইংরেজ বণিকরা তাদের সে অভাব পূরণ করে। ১৬৭০ সালে ইংরেজ কোম্পানির জব চার্নক প্রথম কলকাতায় এসে নোঙর করেন। এর পর থেকেই এ দেশে ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে তাদের স্বার্থের সখ্য জোরদার হতে থাকে। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন বৃহস্পতিবার দুই পক্ষ পলাশীর প্রান্তরে মুখোমুখি হয়। নবাবের বাহিনী নিয়ে কাঠের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকলেন ইয়ার লতিফ, রায় দুর্লভ, মীরজাফর ও মীর মদন। মোহলালসহ দেশপ্রেমিক সৈন্যরা নবাবের পক্ষে যুদ্ধ শুরু করলেন। তাদের হামলায় ইংরেজ বাহিনীর অবস্থা নাজুক হয়ে পড়ে। কিন্তু মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় সে দিন একতরফাভাবে পলাশীতে জয়ী হয়ে ক্লাইভ বিজয়ীর বেশে মুর্শিদাবাদে প্রবেশ করেন। সে দিন প্রত্যেকে যদি একটি করেও ঢিল ক্লাইভের দিকে নিক্ষেপ করত তবে সেখানেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলা দখলের স্বপ্নসাধ ধুলোয় মিশে যেত। ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে তথাকথিত যুদ্ধের পর সিরাজউদ্দৌলা শিশুকন্যা জোহরাকে নিয়ে গোপনে নৌকাযোগে মুর্শিদাবাদ ছেড়ে যেতে বাধ্য হন। পথিমধ্যে রাত যাপনের জন্য রাজমহলের এক মসজিদে আশ্রয় নিলে এর মোতওয়াল্লী দানেশ ফকির বিশ্বাসঘাতকতা করে নবাবকে শত্রুপক্ষের হাতে তুলে দেন। মালদহের ফৌজদার এবং মীরজাফরের ভাই দাউদ খান নবাবকে সপরিবারে বন্দী করে মীরজাফরের জামাতা মীর কাসেমের হেফাজতে মুর্শিদাবাদ পাঠিয়ে দেন। কুখ্যাত মিরনের আদেশে আলীবর্দী খাঁর পালিত নিমকহারাম মোহাম্মদী বেগ জাফরগঞ্জ প্রসাদে নির্জন কক্ষে ২ জুলাই গভীর রাতে নৃশংসভাবে সিরাজকে হত্যা করে। ষড়যন্ত্রকারীরা বিজয় মিছিল শেষে লাশ বাজারের এক ময়লার স্তুপে নিক্ষেপ করে। এ অবস্থায় মাত্র একজন মানুষ সন্ধ্যার পর গিয়ে হাজির হলেন মীরজাফরের দরবারে। তার নাম মীর্জা জয়নুল আবেদীন তিনি মীরজাফরের কাছে সিরাজের লাশ দাফনের অনুমতি চাইলেন। মীরজাফর, ক্লাইভ, জগৎশেঠ, ইয়ার লতিফ ও রাজবল্লভের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলেন, জয়নুল আবেদীনকে সিরাজের লাশ দাফনের জন্য দেওয়া যাবে। তবে তাকে মুর্শিদাবাদ শহরের বাইরে নিয়ে দাফন করতে হবে। মীর্জা জয়নুল সিরাজের খন্ড-বিখন্ড লাশ ভাগীরথী নদীর ওপারে নিয়ে যান। ভাগীরথী নদীর পানি দিয়ে সিরাজকে গোসল করান। তারপর খোশবাগে নবাব আলীবর্দী খাঁর সমাধিসৌধের বারান্দায় তাকে দাফন করেন। সেই থেকে এ দেশের জনগণের ভাগ্যের বিপর্যয় ঘটে। ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের অবসান হয়। এরপর নির্লজ্জভাবে পিতা মীরজাফর ও পুত্র মীরণ উভয়েই লুৎফুন্নেসাকে বিয়ে করার জন্য জোরজবরদস্তি করতে থাকে। কিন্তু এই মহীয়সী নারী উভয়ের প্রস্তাব ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করেন।

১৭৬৫ সালে তিনি মুক্তি পেয়ে কন্যাসহ মুর্শিদাবাদ ফিরে আসেন। এবং অতি দীনহীন ভাবে জীবন কাটাতে থাকেন। ১৭৯০ সালের মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি স্বামী নবাব সিরাজের কবরস্থানে তসবিহ, তাহলিল, তেলাওয়াত, দুআ, দরুদ পাঠ করেই কাটান। মুর্শিদাবাদের তৎকালীন অধিবাসীরা একজন বেগমের প্রতি নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতা অশ্রুসিক্ত নয়নে অবলোকন করছে।

পলাশী যুদ্ধের ব্যাপারে ঐতিহাসিকদের মতামত :

ঐতিহাসিক মেলেসন পলাশীর প্রান্তরে সংঘর্ষকে যুদ্ধ’ বলতে নারাজ। তার মতে, নবাবের পক্ষে ছিল ৫০ হাজার সৈন্য আর ইংরেজদের পক্ষে মাত্র ৩ হাজার সৈন্য। কিন্তু প্রাসাদ ষড়যন্ত্রকারী ও কুচক্রী মীর জাফর, রায় দুর্লভ ও খাদেম হোসেনের অধীনে নবাব বাহিনীর একটি বিরাট অংশ পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কার্যত কোনো অংশগ্রহণ করেনি। এই কুচক্রীদের চক্রান্তে যুদ্ধের প্রহসন হয়েছিল। অপর ঐতিহাসিক ড. রমেশ চন্দ্র বলেন, ‘নবাব ষড়যন্ত্রকারীদের গোপন ষড়যন্ত্রের’ কথা জানার পর যদি মীর জাফরকে বন্দী করতেন, তবে অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারী ভয় পেয়ে যেতো এবং ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হলে পলাশীর যুদ্ধ হতো না।

ইংরেজ ও ষড়যন্ত্রকারীদের অপকর্ম আড়ালের চেষ্টা :

জাতির মধ্যে অনৈক্য এবং ক্ষমতালোভী স্বার্থান্বেষী বিশ্বাসঘাতক গোষ্ঠীদের ষড়যন্ত্রের পাশাপাশি একটা মহল বিশেষ করে নাটক-সিনেমায় নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে অত্যাচারী, নারী লোভী, মাতাল এবং আরো অনেক দোষে দোষী সাব্যস্ত করে। এবং এটাও একটা কারণ হিসেবে তুলে ধরা হয়। তরুণ যুবক সিরাজের কিছু দোষ ত্রুটি থাকাই স্বাভাবিক, অস্বাভাবিক কিছু নয়। সত্যিকারভাবে ইতিহাসের বিচার বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, এগুলো অতিরঞ্জিত। কিশোর সিরাজউদ্দৌলা ক্ষমতায় বসেই ১৪ মাসে কমপক্ষে ১২০০ মাইল দুর্গম পথ তাকে অতিক্রম করতে হয়েছে। নাটকে আলেয়া নামের আর্য সুন্দরীদের মোহাবিষ্ট জালে রূপাকৃষ্ট পতঙ্গের মতো লাম্পট্য লীলায় সময় কাটাবার সুযোগ তিনি পেলেন কোথায়?

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মীরজাফর ও ঘষেটি বেগম প্রচন্ড ক্ষমতালোভী ও জাতীয়তা বিরোধী ছিলেন। ধারাবাহিকতা রক্ষায় তাদের উত্তরসূরীও একই আচরণ অব্যাহত রেখেছে। তারা এ দেশকে প্রতিবেশী দেশের ‘কলোনী’ বা অঙ্গরাজ্য বানাবার স্বপ্নে বিভোর। আর সে কারণেই বিনা শুল্কে ট্রানজিট প্রদানের জীবন মরণ প্রচেষ্টা।

পলাশীর যুদ্ধে দেশি বেনিয়া ও হিন্দুদের ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় ও হত্যার মধ্য দিয়ে মীরজাফরের নেতৃত্বে একটি পুতুল সরকার গঠিত হয়। ইংরেজ ঐতিহাসিকদের সূত্রে প্রাপ্ত বিভিন্ন বিবরণ এবং পাঠ্য পুস্তুকের মাধ্যমেও পলাশীতে নবাবের পতনের জন্য বেশ কিছু কারণকে দায়ী করা হয়। যাতে নবাবের বিভিন্ন দুর্বলতা ও ব্যক্তিগত চরিত্রের উপর আক্রমণ করা হয়েছে। এগুলোর উদ্দেশ্য হচ্ছে ইংরেজ ষড়যন্ত্রকারী ও তাদের দোসরদের অপকর্মকে আড়াল করার অপচেষ্টা মাত্র। নবাব সিরাজউদ্দৌলা কখনও ইংরেজদের উপর আক্রমণ পরিচালনা করেননি। তিনি ইংরেজদের সাথে করা চুক্তি মেনে চলেছিলেন ১৭৫৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত। অল্প বয়স্ক নবাব ক্ষমতা লাভ করে আত্মীয়দের বিরোধিতা ও শত্রুতা মোকাবেলা করে হয়তবা সহজেই সাফল্য লাভ করতে পারতেন। ১৪ মাস ১৪ দিনে তাকে চর্তুদিকে ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করে টিকে থাকতে হয়েছে। কিশোর সিরাজউদ্দৌলা ক্ষমতায় বসেই এই ১৪ মাসে কমপক্ষে ১২০০ মাইল দুর্গম পথ তাকে অতিক্রম করতে হয়েছে। সে সময়ে ছিলো না কোনো উন্নত যানবাহন। করতে হয়েছে পাঁচ, পাঁচটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। চর্তুদিকে অসংখ্য ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করতে হয়েছে। তাকে তো আলেকজান্ডারের চেয়েও দ্রুত গতিতে পথ চলতে হয়েছে। রাত কাটাতে হয়েছে যুদ্ধক্ষেত্রে ও অশ্বপৃষ্ঠে। দিন কাটাতে হয়েছে ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করে। নানাজীর উদ্যোগে সেই অল্প বয়সে বিবাহিত সিরাজের তখন আপন স্ত্রী লুৎফা, শিশু কন্যা জোহরারও প্রতি ফিরে তাকাবারও তো ফুরসত ছিল না। এগুলো আমরা একটু গভীরভাবে উপলব্ধি করলেই তো বুঝতে পারার কথা। কেবলমাত্র সিরাজের প্রতি নিষ্ঠুরতাকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য হতভাগ্য নবাবের চরিত্রহনন করা হয়। নানা ধরণের মিথ্যাচারের মাধ্যমে কলঙ্কিত করা হয় তরুণ নবাবকে।নিষ্ঠুরতা কত ভয়াবহ ছিলো?

ব্যক্তিগত অদূরদর্শিতা বা চারিত্রিক ত্রুটির জন্য সিরাজউদ্দৌলা ব্যর্থ হননি। ব্যর্থতার কারণ ছিল তাঁর প্রশাসনের লোকদের বৈরিতা ও বিশ্বাসঘাতকতা। প্রভাবশালী বাঙালিদের স্বার্থপরতা। মোঘল সম্রাজ্যের অংশ হিসেবে বাংলার দুর্বলতর অবিচ্ছেদ্যতা। বাংলার অবিকশিত নৌবাহিনীর ষড়যন্ত্র আর কূট-কৌশলের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠাকারী ব্রিটিশ সম্রাজ্যবাদের ঘৃণ্য পরিকল্পনা। সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মাধ্যমে ইউরোপের কাছে এশিয়ার পরাজয় ঘটে।

ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায় :

নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতন বাঙালি ও বাংলাদেশীদের জীবন ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। বয়সে তরুণ হলেও নবাব সিরাজউদ্দৌলার চিন্তা ছিল নিখুঁত ও নির্ভুল। সিরাজউদ্দৌলা বুঝতে পেরেছিলেন বিদেশি ইংরেজরাই একদিন এদেশের স্বাধীনতা ও সম্পদ কেড়ে নিতে পারে। তিনি যাদেরকে বিশ্বাস করেছিলেন, তারাই ইংরেজদের সাথে চক্রান্তে লিপ্ত হয়ে তার বিপক্ষে চলে যায়। পরাজিত হয়ে নবাব শেষ মুহূর্তে ঘাতকের কাছে প্রাণভিক্ষা নয়; ওজু করে দু রাকাত সালাত আদায়ের সুযোগ দানের অনুরোধ করেছিলেন। তা রক্ষা করা হয়নি। স্বদেশ ও স্বজাতির বিরুদ্ধে এ রকম নাফরমানির নজির অন্য কোন জাতির ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবে না। সিরাজউদ্দৌলা দেশের জন্য জীবন দিয়ে আজও বেঁচে আছেন মানুষের হৃদয়জুড়ে। তার আদর্শ থেকে জন্ম নিয়েছেন শত শত বীরযোদ্ধা, ফকির মজনুশাহ, হাজী শরীয়তউল্লাহ, তিতুমীর ও হাবিলদার রজব আলীর মতো মুজাহিদরা। নিষ্ঠুর শোষণ-নিপীড়ন ও নির্মম গণহত্যার মাধ্যমে ব্রিটিশরা মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত। বিশ্ব ইতিহাসে এ অপরাধের কোনও বিচার এখনও হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে ইহুদি হত্যাকন্ড, ভিয়েতনামের মাইলাই হত্যাকান্ড, বসনিয়ার মুসলিম গণহত্যা, ৫০ বছর পর বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের ভূমিকার জন্য যদি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হতে পারে; তাহলে উপমহাদেশে লাখ লাখ গণহত্যা এবং বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের সম্পদ পাচারের দায়ে অপরাধী ঘাতকদের বিচার হবে না কেন? স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় নবাব সিরাজউদ্দৌলা হয়ত সফলতা লাভ করতে পারেন নি। কিন্তু তিনি স্বদেশকে তুলে দেননি সা¤্রাজ্যবাদের হাতে। পরাজয়ের পর তিনি হয়ত নিজের শেষ রক্ষা করার জন্য আপোষ করতে পারতেন; তিনি তার জন্য বিন্দুমাত্র চেষ্টাও করেন নি। শহীদ নবাব সিরাজউদ্দৌলা প্রতিটি দেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের জন্য প্রেরণা এক অমীয় উৎস। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার শাহাদাতকে কবুল করুন। আমীন

সিরাজের অনুগত, দেশপ্রেমিক সেনাপতি ও আমত্যদেরও একে একে হত্যা-নির্যাতনের শিকারে পরিণত করা হয়। ষড়যন্ত্রকারী রায়দুর্লভ বিষ প্রয়োগে হত্যা করেন অকৃত্রিম সিরাজভক্ত মোহনলালকে। খাজা আবদুল হাদি খানকে মীরজাফর মেরে ফেলেন বিশ্বাসঘাতকতা করে। সিরাজ অনুগত ঢাকার ভূতপূর্ব নায়েব রায় বল্লভ সেনকে গঙ্গার জলে ডুবিয়ে মারা হয়। পাটনার নায়েব, আরেক সিরাজ সুহৃদ, রামনারায়ণকেও খুবই নিষ্ঠুরভাবে খুন করা হয়। মোটের ওপর, পলাশীর যুদ্ধের ২০ বছরের মধ্যে প্রায় সকল সিরাজ অনুগত সেনাপতি, আমীর-ওমরাহকে সমূলে নিশ্চিহ্ন করা হয়।

পলাশীর প্রান্তরে পরাজয়ের কারণ :

এত সৈন্য, শক্তি-সামর্থ থাকার পরেও কেন পলাশীর প্রান্তরে মুসলিমদের শোচনীয়ভাবে পরাজয় হয়েছিলো? এর কারণ হলো দুটি।

এক. আমরা শত্রু চিনতে ভুল করি। মীর জাফর বারবার ষড়যন্ত্র করা সত্ত্বেও নবাব সিরাজউদ্দৌলা তাঁর উপর নির্ভরশীল হতে দেখা যায়। হয়তো নবাবের বয়স কম এবং সহজ সরল ছিলেন বলেই। এটা বাঙালির মজ্জাগত স্বভাব। আমরা শত্রু চিনতে বার বার ভুল করি। বিশ্বাসঘাতকদের বার বার বিশ্বাস ভঙ্গের সুযোগ করে দিই।

দুই. এই কারণটা ইতিহাসবিদ উইলিয়াম ড্যালরিম্পল এর মুখেই শুনুন, তার লেখা নতুন বই ‘দ্য অ্যানারকি: দ্য রিলেন্টলেস রাইজ অব দ্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ এ নিয়ে লিখেন, “অলস বাঙালিদের জন্যই পলাশী যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলা হেরে গেছেন।”

এই বিষয়ে রবার্ট ক্লাইভ তার আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, সে দিন স্থানীয় অধিবাসীরা ইংরেজদের প্রতিরোধ করতে চাইলে লাঠিসোটা আর হাতের ইটপাটকেল মেরেই তাদের খতম করে দিতে পারতো। কিন্তু এ দেশবাসীরা তা উপলব্ধি করতে পারেনি। যেকোনো কারণেই হোক সে দিন বাংলার মানুষ এগিয়ে যায়নি। তাদের রাজনৈতিক সচেতনতার তখন খুবই অভাব ছিল।

আসলে আমরা বরাবরই অলস, অসচেতন, স্বার্থপর এবং নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা জাতি। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, পলাশীর ট্র্যাজেডির পরেও বাংলার সাধারণ মানুষ, কৃষক সমাজ দৈনন্দিন জীবন, নিত্যদিনের মতোই মাঠে কৃষি কাজ করেছে। ফসল বুনেছে। অথচ পলাশীর যুদ্ধে গোটা জাতীয় জীবনে কি নিদারুণ ভাগ্য বিপর্যয় ঘটলো, এক ঘণ্টার প্রহসনের যুদ্ধে গোটা জাতির স্বাধীনতা হরণ করে নিয়ে গেল কয়েক বেনিয়া ইংরেজ অথচ তাদের কারো টনক নড়লো না। টনক যখন নড়লো, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাদের আর তখন কিছুই করার ছিল না।

মীর জাফরদের শেষ পরিণতি :

কিন্তু বাংলার ট্র্যাজেডি এই যে, মীরজাফরেরা বারবার গোর থেকে উঠে আসে। একটা কথা বার বার উচ্চারিত হয়, পলাশীর ঐতিহাসিক ঘটনা থেকে আমরা শিক্ষা নিই নাই। কারণ ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নেয়া বাঙালির মজ্জাগত ব্যাপার। এত নির্যাতন, নিপীড়ন চালানোর কুশলীব যারা ছিলেন, তাদের কি পরিণতি হয়েছিলো তা তুলে ধরছি, এতে যদি কেউ শিক্ষা নিই আর কি। বর্তমান ও ভবিষ্যতে পর্দার আড়ালে এমন কিছু করার আগে যেন হাজার বার ভাবতে হয়।

মহান সৃষ্টিকর্তা যে সবকিছুর বিচার করেন, তা আমরা পলাশীর প্রেক্ষাপট তৈরির খলনায়কদের নির্মম পরিণতি দেখে কিছুটা হলেও বুঝতে পারি। সিরাজের হত্যাকারী মোহাম্মদী বেগ উন্মাদ অবস্থায় দাম্পত্য কলহে এক কূপে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে। মীরনের মৃত্যু ঘটেছিল বজ্রপাতে। তার আগে সিরাজের খালা ষড়যন্ত্রকারী ঘসেটি বেগমকে মীরণ প্রবল খরস্রোতা বুড়িগঙ্গায় নৌকা ডুবিয়ে মেরে ফেলে। মীর জাফর ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে দুদুবার বাংলার মসনদে বসেছিলেন। কিন্তু শেষ বয়সে মারাত্মক কুষ্ঠ ব্যাধিতে তার ভবলীলা সাঙ্গ হয়।

মীর কাশিম আলী খান পরবর্তীতে বাঙলার নবাব হয়েছিলেন; কিন্তু শুরুতেই তিনি ছিলেন বাংলার মুসিলম শাসন অবসানের মূল ষড়যন্ত্রের অন্যতম সহযোগী। ভগবান গোলায় নবাবকে তিনি সর্বপ্রথম ধরিয়ে দেন তার শ্যালক মীরণের হাতে। শেষ পর্যায়ে এসে মীর কাশিম অনুধাবন করলেন একদা এই চক্রের সাথে হাত মিলিয়ে তিনি বাঙলার মুসলমানদের স্বার্থের চরম ক্ষতি সাধন করেছেন, এখন আর কোনো উপায় নেই।

মীর কাশিম বুঝলেন ঠিকই, কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। কিন্তু মূল ষড়যন্ত্রকারীরা কি চিরকালই পর্দার অন্তরালে থেকে যাবে? মুঙ্গেরের দুর্গশীর্ষ থেকে বস্তায় ভরে গঙ্গার বুকে তিনি নিক্ষেপ করেন জগৎশেঠ আর রায়দুর্লভের জীবন্ত দেহ। অপর এক অপঘাতে নিহত হলো রাজা রাজ বল্লভ। পরবর্তীকালে তার সব কীর্তি পদ্মা নদী গ্রাস করে কীর্তিনাশা নামধারণ করলো।

কিন্তু এত করেও মীর কাশিম তার শেষ রক্ষা করতে পারলেন না। বক্সারের যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর ইংরেজ কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে বনে জঙ্গলে আত্মগোপন করেই রইলেন। জঙ্গলেই তার দুই ছেলে নিহত হন। নির্বংশ মীর কাশিম আলী খান এরপর কোথায় উধাও হয়ে যান ইতিহাস সে সম্পর্কে নীরব। দীর্ঘ দিন পর তার লাশ পাওয়া যায় দিল্লির আজমেরি গেটের কাছে রাস্তার ওপরে।

ষড়যন্ত্রকারীদের ইংরেজরা প্রায়ই প্রচুর অর্থবিত্ত এবং পদক, পদবি দিয়ে তুষ্ট করত বলে জানা যায়। এ রকম এক পদক বিতরণী অনুষ্ঠানে হাজির হয়েও পদক প্রাপ্ত হিসেবে ডাক না পাওয়ায় অপমানে, ক্ষোভে সভাস্থলে উমিচাঁদের হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান। নন্দকুমার ভূষিত ছিল মহারাজা উপাধিতে কিন্তু ওয়ারেন হেস্টিংসের সাজানো মামলায় আসামি হিসেবে তাকে শেষ পর্যন্ত শেওড়া গাছে ঝুলতে হয় ফাঁসি কাষ্ঠে।

ইয়ার লতিফ নিরুদ্দেশ হয়ে গোপনে মৃত্যুবরণ করেন। রায় দুর্লভ ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়ে কারাগারে ধুকে ধুকে মারা গেছেন।স্ক্যাপ্টন বাংলায় লুটপাট করে বিলেতে ফেরার পথে জাহাজ ডুবিতে মারা যায়। ওয়াটসন কোম্পানির চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়ে মনের দুঃখে ও অনুশোচনায় ক্রমাগত অসুস্থ হয়ে কোনো ঔষুধে প্রতিকার না পেয়ে শোচনীয়ভাবে মৃত্যু বরণ করেন।

এভাবেই দেখা যায় বাংলার মুসলমানদের স্বার্থবিরোধী ভূমিকা পালনকারীদের ইতিহাস কাউকেই ক্ষমা করেনি, চক্রান্তকারীদের ভোগ করতে হয়েছে মর্মান্তিক পরিণতি।

সিরাজউদ্দৌলা কখনো তার দেশের প্রজাদের সাথে কোনো অবস্থাতেই বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। কখনো স্বেচ্ছায় স্বদেশকে বিকিয়ে দেননি। তার চরিত্রেও কোনো কালিমা ছিলো না। পলাশীর প্রান্তরে মর্মান্তি নাট্যমঞ্চে এক মাত্র তিনি ছিলেন মূল নায়ক। সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন বাঙলার স্বাধীনতার শেষ প্রতীক।

লেখক

পরিচালক, মারকাযুস সুন্নাহ, ঢাকা

সেক্রেটারী, সেন্টার ফর রিসার্চ এন্ড কমিউনিটি ডেভেলোপমেন্ট (সিআরসিডি)

নিউজটি শেয়ার করুন

পলাশীর ইতিহাস

পলাশীর ট্র্যাজেডী, ইউরোপের কাছে এশিয়ার পরাজয়

আপডেট সময় : ০৩:৫৭:৫৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ২১ জুন ২০২৩

 – মোঃ মাছউদুর রহমান

২৩ জুন ঐতিহাসিক পলাশী ট্রাজেডি দিবস। এটি বাঙালির ইতিহাসে এক কালো অধ্যায়। ২৬৬ বছর আগে ১৭৫৭ সালের এই দিনে ভাগীরথী তীরে পলাশীর আম বাগানে ইংরেজদের সঙ্গে এক প্রহসনের যুদ্ধে বাংলা বিহার ও উড়িষ্যার নবাব সিরাজ উদ্দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে অস্তমিত হয় বাংলার স্বাধীনতার শেষ সূর্য। অবসান হয় ভারত বর্ষে মুসলিম শাসনের। মীরজাফর-ঘষেটি বেগমরা সেই প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের কুশীলব। পলাশী দিবস উদযাপনে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠন কর্মসূচি দিয়ে থাকলেও এর থেকে শিক্ষা নেয়নি অনেকেই।

প্রহসনের ঐ যুদ্ধে পরাজয়ের পর নবাবের বেদনাদায়ক মৃত্যু হলেও উপমহাদেশের মানুষ নবাবকে আজও শ্রদ্ধা জানায়। তার সঙ্গে যারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল তাদের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। পক্ষান্তরে মীরজাফর আজ বেঈমানের প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ঘৃণিত এই নামটি কোন মা-বাবাই সন্তানের জন্য রাখতে চান না।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, নবাবের সেনাবাহিনীর তুলনায় ইংরেজদের সেনা সংখ্যা ছিল অনেক কম। সেখানে বিশ্বাসঘাতকতা না হলে নবাবের বিজয় ছিল সুনিশ্চিত। নবাব ষড়যন্ত্রকারীদের গোপন ষড়যন্ত্রের কথা জানার পর যদি মীর জাফরকে বন্দী করতেন, তবে অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারী ভয় পেয়ে যেত এবং ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হলে পলাশীর যুদ্ধ হতো না।

ইতিহাসবিদ মোবাশ্বের আলী তার ‘বাংলাদেশের সন্ধানে’ গ্রন্থে লিখেছেন, নবাব সিরাজউদ্দৌলা প্রায় এক লাখ সেনা নিয়ে ক্লাইভের স্বল্পসংখ্যক সেনার কাছে পরাজিত হন মীর জাফরের মোনাফেকিতে।

বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাব আলিবর্দী খাঁ মৃত্যুর আগে দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলাকে নবাবের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী করে যান। নবাব আলিবর্দী খাঁর মৃত্যুর পর ১৭৫৬ সালের এপ্রিল মাসে সিরাজউদ্দৌলা সিংহাসনে বসেন। নবাবের খালা ঘোষেটি বেগম তার ছেলেকে উত্তরাধিকারী না বানানোর কারণে ইংরেজদের সাথে হাত মেলান। সেনাপতি মীর জাফর আলী খান, ধনকুবের জগৎ শেঠ, রাজা রায় দুর্লভ, উমিচাঁদ, ইয়ার লতিফ প্রমুখ ইংরেজদের সাথে ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠেন। ধূর্ত ইংরেজরা সন্ধির চুক্তি ভঙ্গ করে চন্দন নগরের ফরাসিদের দুর্গ দখল করে নেয়।

এরপর ১৭৫৭ সালের ১৭ জুন ক্লাইভ কাটোয়ায় অবস্থান নেয়। নবাব ২২ জুন ইংরেজদের আগেই পলাশী পৌঁছে শিবির স্থাপন করেন। ২৩ জুন সকাল ৮টায় যুদ্ধ শুরু হয়। কিন্তু প্রধান সেনাপতি মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় নবাবের পরাজয় ঘটে।

ট্র্যাজেডী বলার কারণ :

পলাশীর এই ঘটনা যুদ্ধ না-বলে একে ট্র্যাজেডি বা বিপর্যয় বলাই অধিকতর যুক্তিসঙ্গত। কেননা যুদ্ধ করে জয় পরাজয় এক কথা। আর যুদ্ধ না-করে যে পরাজয় বরণ করা সম্পূর্ণ ভিন্ন। অনেকে একে যুদ্ধ না-বলে `ষড়যন্ত্রের কালো থাবা’ বলে থাকেন। এ নিন্দনীয় প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে একদল লোভী, ষড়যন্ত্রকারী, স্বার্থান্বেষী, দেশদ্রোহী হিন্দু-মুসলিম মিলিত মানুষরা দেশপ্রেমিক নবাব সিরাজউদ্দৌলার মত লোককে পরাজিত ও নিহত করে নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির চেষ্টা করেছিল। তাই পলাশীর ট্রাজেডি না দেখলে হয়তবা পৃথিবীর মানুষ কখনোই জানত না ষড়যন্ত্র কাকে বলে? পলাশীর ঘটনা একটি সাধারণ ঘটনা নয়। এর ভেতরে লুকিয়ে আছে বাংলাসহ এ অঞ্চলের মানুষের ২০০ বছরের পরাধীনতার শিকল। আজকেও তেমন দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা, দেশী-বিদেশী সাম্রাজ্যবাদীদের পা চাটা স্বার্থন্বেষী গোলামদের ষড়যন্ত্রের কারণে হুমকীর মুখোমখি। প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের ন্যায় ইঙ্গ-মার্কিন আগ্রাসন, দিল্লীর বায়বীয় ইশারা, হাওয়া ভবন, গণভবন-বঙ্গভবনের বিদেশ তোষণ বাঙ্গালী জাতিকে ক্ষতবিক্ষত করেছে প্রতিনিয়ত।

পলাশী ট্র্যাজেডী থেকে শিক্ষা : 

নবাব সিরাজউদ্দৌলা সততা, দক্ষতা আর দেশাত্মবোধ নিয়ে ১৪ মাস ১৪ দিন বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা শাসন করেন। মাতামহ (নানা) আলীবর্দী খাঁ শত্রুদের দমন এবং প্রজাদের কল্যাণে তাকে নিয়োজিত করেন এবং সব অন্যায়-অবিচার দূর করার উপদেশ দেন। মাতামহের মৃত্যুশয্যায় সিরাজ পবিত্র কুরআন স্পর্শ করে শপথ করেন দেশ, মাটি ও মানুষের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করবেন। সিরাজকে পরিবারের ভেতরে-বাইরের শত্রুদের ব্যাপক মোকাবেলা করতে হয়। নবাব পদে সিরাজের মনোনয়নে (খালা) ঘসেটি বেগম, রাজবল্লভ, মীরজাফর ও শওকত জং তার প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠে। মুর্শিদাবাদের শাসক শ্রেণী ও প্রভাবশালী মহল প্রথম দিকের নবাবদের সময় ধনসম্পদ কুক্ষিগত করার কাজে নিয়োজিত ছিল। সিরাজ শাসন ক্ষমতায় আরোহণের সাথে সাথে এ গোষ্ঠী আশঙ্কা করে যে, তরুণ নবাব বিপজ্জনক হতে পারে। সিরাজের সিংহাসন লাভ ইংরেজদের জন্য ছিল হুমকিস্বরূপ। কেননা পূর্ববর্তী নবাবদের মতো সিরাজ তাদের অধিকারের অপব্যবহার মেনে নিতে অস্বীকার করেন। চক্রান্তকারীরা ইংরেজদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে মুসলিম জাতিসত্তার কর্তৃত্ব ও নেতৃত্বের পরিবর্তে সাময়িক কায়েমি ও স্বার্থান্বেষী মহলের ক্ষমতা লাভের চেষ্টায় রত ছিল। কিভাবে কোটি কোটি মানুষের গলায় গোলামীর জিঞ্জির পরিয়ে দিয়েছে পলাশীর ঘটনাবলী আমাদের তাই স্মরণ করিয়ে দেয়। কিন্তু ইতিহাসের চরম ট্রাজেডী হচ্ছে কেউ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না। সচেতন দেশপ্রেমিকদেরকে তাই আজ পলাশীর পরিণতিকে সামনে রেখে দেশবাসীকে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের বিরুদ্ধে সোচ্চার করাতে হবে এবং আরেকটি পলাশীর চক্রান্ত থেকে দেশকে রক্ষা করতে হবে। উচ্চাভিলাষী মীর জাফর ও বর্ণবদী হিন্দুদের ষড়যন্ত্রের পলাশী প্রান্তে বাংলার স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়। তাই এ যুগের ঘষেটি বেগম, মীরজাফর ও জগৎশেঠদের দোসরদের কোনভাবে বিশ্বাস করার প্রয়োজন নেই। এটাই পলাশী দিবসের শিক্ষা।

পলাশীর যুদ্ধে পর ধীরে ধীরে সমগ্র উপমহাদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। সিরাজউদ্দৌলার ত্রুটি ছিল তিনি সব প্রতিদ্বন্দী একই সাথে মোকাবেলা করতে চেয়েছিলেন। মুসলিম শাসকরা যতদিন সংস্কৃতির ব্যাপারে সচেতন ছিলেন ততদিন চারদিক থেকে সমৃদ্ধি এসেছে। কিন্তু যখন তারা শুধু সামরিক ও রাজনৈতিক যোগ্যতার ওপর বেশি নির্ভর করেছেন, তখন তাদের ভৌগোলিক স্বাধীনতাও বিপন্ন হয়েছে। স¤্রাট আকবর দীন-ই-ইলাহি নামে এক অদ্ভুত জগাখিচুড়ি ধর্ম প্রচার করেন। ফলে উপমহাদেশে মুসলিম শাসনের পতনের সূচনা হয়। ১৭০৭ সাল থেকেই ভারতবর্ষে মুসলিম শাসন দুর্বল হতে থাকে। জনকল্যাণের পরিবর্তে আরাম-আয়েশে আগ্রহী হয়ে ওঠার ফলে জনগণের সাথে শাসকদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। শত্রুর ব্যাপারে জনগণ সচেতন ছিলেন না। এ কারণে পলাশীর ঘটনার আগে রাষ্ট্রের শক্তি ও সংহতি দুর্বল হয়ে পড়ে। ব্রিটিশ বণিকরা ছিল মুসলিমবিদ্বেষী। আর ব্যবসার আড়ালে এ দেশে তাদের দোসর খুঁজতে থাকে। মুসলমানের দুশমনরাই তাদের নির্ভরযোগ্য বন্ধু হয়ে ওঠে। মুসলিম শাসন ধ্বংস করার জন্য এ দেশের ভেতর একটি শক্তি সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। তারা ছিল চক্রান্তকারী, কিন্তু সাহস কম ছিল। ইংরেজ বণিকরা তাদের সে অভাব পূরণ করে। ১৬৭০ সালে ইংরেজ কোম্পানির জব চার্নক প্রথম কলকাতায় এসে নোঙর করেন। এর পর থেকেই এ দেশে ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে তাদের স্বার্থের সখ্য জোরদার হতে থাকে। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন বৃহস্পতিবার দুই পক্ষ পলাশীর প্রান্তরে মুখোমুখি হয়। নবাবের বাহিনী নিয়ে কাঠের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকলেন ইয়ার লতিফ, রায় দুর্লভ, মীরজাফর ও মীর মদন। মোহলালসহ দেশপ্রেমিক সৈন্যরা নবাবের পক্ষে যুদ্ধ শুরু করলেন। তাদের হামলায় ইংরেজ বাহিনীর অবস্থা নাজুক হয়ে পড়ে। কিন্তু মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় সে দিন একতরফাভাবে পলাশীতে জয়ী হয়ে ক্লাইভ বিজয়ীর বেশে মুর্শিদাবাদে প্রবেশ করেন। সে দিন প্রত্যেকে যদি একটি করেও ঢিল ক্লাইভের দিকে নিক্ষেপ করত তবে সেখানেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলা দখলের স্বপ্নসাধ ধুলোয় মিশে যেত। ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে তথাকথিত যুদ্ধের পর সিরাজউদ্দৌলা শিশুকন্যা জোহরাকে নিয়ে গোপনে নৌকাযোগে মুর্শিদাবাদ ছেড়ে যেতে বাধ্য হন। পথিমধ্যে রাত যাপনের জন্য রাজমহলের এক মসজিদে আশ্রয় নিলে এর মোতওয়াল্লী দানেশ ফকির বিশ্বাসঘাতকতা করে নবাবকে শত্রুপক্ষের হাতে তুলে দেন। মালদহের ফৌজদার এবং মীরজাফরের ভাই দাউদ খান নবাবকে সপরিবারে বন্দী করে মীরজাফরের জামাতা মীর কাসেমের হেফাজতে মুর্শিদাবাদ পাঠিয়ে দেন। কুখ্যাত মিরনের আদেশে আলীবর্দী খাঁর পালিত নিমকহারাম মোহাম্মদী বেগ জাফরগঞ্জ প্রসাদে নির্জন কক্ষে ২ জুলাই গভীর রাতে নৃশংসভাবে সিরাজকে হত্যা করে। ষড়যন্ত্রকারীরা বিজয় মিছিল শেষে লাশ বাজারের এক ময়লার স্তুপে নিক্ষেপ করে। এ অবস্থায় মাত্র একজন মানুষ সন্ধ্যার পর গিয়ে হাজির হলেন মীরজাফরের দরবারে। তার নাম মীর্জা জয়নুল আবেদীন তিনি মীরজাফরের কাছে সিরাজের লাশ দাফনের অনুমতি চাইলেন। মীরজাফর, ক্লাইভ, জগৎশেঠ, ইয়ার লতিফ ও রাজবল্লভের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলেন, জয়নুল আবেদীনকে সিরাজের লাশ দাফনের জন্য দেওয়া যাবে। তবে তাকে মুর্শিদাবাদ শহরের বাইরে নিয়ে দাফন করতে হবে। মীর্জা জয়নুল সিরাজের খন্ড-বিখন্ড লাশ ভাগীরথী নদীর ওপারে নিয়ে যান। ভাগীরথী নদীর পানি দিয়ে সিরাজকে গোসল করান। তারপর খোশবাগে নবাব আলীবর্দী খাঁর সমাধিসৌধের বারান্দায় তাকে দাফন করেন। সেই থেকে এ দেশের জনগণের ভাগ্যের বিপর্যয় ঘটে। ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের অবসান হয়। এরপর নির্লজ্জভাবে পিতা মীরজাফর ও পুত্র মীরণ উভয়েই লুৎফুন্নেসাকে বিয়ে করার জন্য জোরজবরদস্তি করতে থাকে। কিন্তু এই মহীয়সী নারী উভয়ের প্রস্তাব ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করেন।

১৭৬৫ সালে তিনি মুক্তি পেয়ে কন্যাসহ মুর্শিদাবাদ ফিরে আসেন। এবং অতি দীনহীন ভাবে জীবন কাটাতে থাকেন। ১৭৯০ সালের মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি স্বামী নবাব সিরাজের কবরস্থানে তসবিহ, তাহলিল, তেলাওয়াত, দুআ, দরুদ পাঠ করেই কাটান। মুর্শিদাবাদের তৎকালীন অধিবাসীরা একজন বেগমের প্রতি নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতা অশ্রুসিক্ত নয়নে অবলোকন করছে।

পলাশী যুদ্ধের ব্যাপারে ঐতিহাসিকদের মতামত :

ঐতিহাসিক মেলেসন পলাশীর প্রান্তরে সংঘর্ষকে যুদ্ধ’ বলতে নারাজ। তার মতে, নবাবের পক্ষে ছিল ৫০ হাজার সৈন্য আর ইংরেজদের পক্ষে মাত্র ৩ হাজার সৈন্য। কিন্তু প্রাসাদ ষড়যন্ত্রকারী ও কুচক্রী মীর জাফর, রায় দুর্লভ ও খাদেম হোসেনের অধীনে নবাব বাহিনীর একটি বিরাট অংশ পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কার্যত কোনো অংশগ্রহণ করেনি। এই কুচক্রীদের চক্রান্তে যুদ্ধের প্রহসন হয়েছিল। অপর ঐতিহাসিক ড. রমেশ চন্দ্র বলেন, ‘নবাব ষড়যন্ত্রকারীদের গোপন ষড়যন্ত্রের’ কথা জানার পর যদি মীর জাফরকে বন্দী করতেন, তবে অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারী ভয় পেয়ে যেতো এবং ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হলে পলাশীর যুদ্ধ হতো না।

ইংরেজ ও ষড়যন্ত্রকারীদের অপকর্ম আড়ালের চেষ্টা :

জাতির মধ্যে অনৈক্য এবং ক্ষমতালোভী স্বার্থান্বেষী বিশ্বাসঘাতক গোষ্ঠীদের ষড়যন্ত্রের পাশাপাশি একটা মহল বিশেষ করে নাটক-সিনেমায় নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে অত্যাচারী, নারী লোভী, মাতাল এবং আরো অনেক দোষে দোষী সাব্যস্ত করে। এবং এটাও একটা কারণ হিসেবে তুলে ধরা হয়। তরুণ যুবক সিরাজের কিছু দোষ ত্রুটি থাকাই স্বাভাবিক, অস্বাভাবিক কিছু নয়। সত্যিকারভাবে ইতিহাসের বিচার বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, এগুলো অতিরঞ্জিত। কিশোর সিরাজউদ্দৌলা ক্ষমতায় বসেই ১৪ মাসে কমপক্ষে ১২০০ মাইল দুর্গম পথ তাকে অতিক্রম করতে হয়েছে। নাটকে আলেয়া নামের আর্য সুন্দরীদের মোহাবিষ্ট জালে রূপাকৃষ্ট পতঙ্গের মতো লাম্পট্য লীলায় সময় কাটাবার সুযোগ তিনি পেলেন কোথায়?

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মীরজাফর ও ঘষেটি বেগম প্রচন্ড ক্ষমতালোভী ও জাতীয়তা বিরোধী ছিলেন। ধারাবাহিকতা রক্ষায় তাদের উত্তরসূরীও একই আচরণ অব্যাহত রেখেছে। তারা এ দেশকে প্রতিবেশী দেশের ‘কলোনী’ বা অঙ্গরাজ্য বানাবার স্বপ্নে বিভোর। আর সে কারণেই বিনা শুল্কে ট্রানজিট প্রদানের জীবন মরণ প্রচেষ্টা।

পলাশীর যুদ্ধে দেশি বেনিয়া ও হিন্দুদের ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় ও হত্যার মধ্য দিয়ে মীরজাফরের নেতৃত্বে একটি পুতুল সরকার গঠিত হয়। ইংরেজ ঐতিহাসিকদের সূত্রে প্রাপ্ত বিভিন্ন বিবরণ এবং পাঠ্য পুস্তুকের মাধ্যমেও পলাশীতে নবাবের পতনের জন্য বেশ কিছু কারণকে দায়ী করা হয়। যাতে নবাবের বিভিন্ন দুর্বলতা ও ব্যক্তিগত চরিত্রের উপর আক্রমণ করা হয়েছে। এগুলোর উদ্দেশ্য হচ্ছে ইংরেজ ষড়যন্ত্রকারী ও তাদের দোসরদের অপকর্মকে আড়াল করার অপচেষ্টা মাত্র। নবাব সিরাজউদ্দৌলা কখনও ইংরেজদের উপর আক্রমণ পরিচালনা করেননি। তিনি ইংরেজদের সাথে করা চুক্তি মেনে চলেছিলেন ১৭৫৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত। অল্প বয়স্ক নবাব ক্ষমতা লাভ করে আত্মীয়দের বিরোধিতা ও শত্রুতা মোকাবেলা করে হয়তবা সহজেই সাফল্য লাভ করতে পারতেন। ১৪ মাস ১৪ দিনে তাকে চর্তুদিকে ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করে টিকে থাকতে হয়েছে। কিশোর সিরাজউদ্দৌলা ক্ষমতায় বসেই এই ১৪ মাসে কমপক্ষে ১২০০ মাইল দুর্গম পথ তাকে অতিক্রম করতে হয়েছে। সে সময়ে ছিলো না কোনো উন্নত যানবাহন। করতে হয়েছে পাঁচ, পাঁচটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। চর্তুদিকে অসংখ্য ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করতে হয়েছে। তাকে তো আলেকজান্ডারের চেয়েও দ্রুত গতিতে পথ চলতে হয়েছে। রাত কাটাতে হয়েছে যুদ্ধক্ষেত্রে ও অশ্বপৃষ্ঠে। দিন কাটাতে হয়েছে ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করে। নানাজীর উদ্যোগে সেই অল্প বয়সে বিবাহিত সিরাজের তখন আপন স্ত্রী লুৎফা, শিশু কন্যা জোহরারও প্রতি ফিরে তাকাবারও তো ফুরসত ছিল না। এগুলো আমরা একটু গভীরভাবে উপলব্ধি করলেই তো বুঝতে পারার কথা। কেবলমাত্র সিরাজের প্রতি নিষ্ঠুরতাকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য হতভাগ্য নবাবের চরিত্রহনন করা হয়। নানা ধরণের মিথ্যাচারের মাধ্যমে কলঙ্কিত করা হয় তরুণ নবাবকে।নিষ্ঠুরতা কত ভয়াবহ ছিলো?

ব্যক্তিগত অদূরদর্শিতা বা চারিত্রিক ত্রুটির জন্য সিরাজউদ্দৌলা ব্যর্থ হননি। ব্যর্থতার কারণ ছিল তাঁর প্রশাসনের লোকদের বৈরিতা ও বিশ্বাসঘাতকতা। প্রভাবশালী বাঙালিদের স্বার্থপরতা। মোঘল সম্রাজ্যের অংশ হিসেবে বাংলার দুর্বলতর অবিচ্ছেদ্যতা। বাংলার অবিকশিত নৌবাহিনীর ষড়যন্ত্র আর কূট-কৌশলের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠাকারী ব্রিটিশ সম্রাজ্যবাদের ঘৃণ্য পরিকল্পনা। সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মাধ্যমে ইউরোপের কাছে এশিয়ার পরাজয় ঘটে।

ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায় :

নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতন বাঙালি ও বাংলাদেশীদের জীবন ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। বয়সে তরুণ হলেও নবাব সিরাজউদ্দৌলার চিন্তা ছিল নিখুঁত ও নির্ভুল। সিরাজউদ্দৌলা বুঝতে পেরেছিলেন বিদেশি ইংরেজরাই একদিন এদেশের স্বাধীনতা ও সম্পদ কেড়ে নিতে পারে। তিনি যাদেরকে বিশ্বাস করেছিলেন, তারাই ইংরেজদের সাথে চক্রান্তে লিপ্ত হয়ে তার বিপক্ষে চলে যায়। পরাজিত হয়ে নবাব শেষ মুহূর্তে ঘাতকের কাছে প্রাণভিক্ষা নয়; ওজু করে দু রাকাত সালাত আদায়ের সুযোগ দানের অনুরোধ করেছিলেন। তা রক্ষা করা হয়নি। স্বদেশ ও স্বজাতির বিরুদ্ধে এ রকম নাফরমানির নজির অন্য কোন জাতির ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবে না। সিরাজউদ্দৌলা দেশের জন্য জীবন দিয়ে আজও বেঁচে আছেন মানুষের হৃদয়জুড়ে। তার আদর্শ থেকে জন্ম নিয়েছেন শত শত বীরযোদ্ধা, ফকির মজনুশাহ, হাজী শরীয়তউল্লাহ, তিতুমীর ও হাবিলদার রজব আলীর মতো মুজাহিদরা। নিষ্ঠুর শোষণ-নিপীড়ন ও নির্মম গণহত্যার মাধ্যমে ব্রিটিশরা মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত। বিশ্ব ইতিহাসে এ অপরাধের কোনও বিচার এখনও হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে ইহুদি হত্যাকন্ড, ভিয়েতনামের মাইলাই হত্যাকান্ড, বসনিয়ার মুসলিম গণহত্যা, ৫০ বছর পর বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের ভূমিকার জন্য যদি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হতে পারে; তাহলে উপমহাদেশে লাখ লাখ গণহত্যা এবং বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের সম্পদ পাচারের দায়ে অপরাধী ঘাতকদের বিচার হবে না কেন? স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় নবাব সিরাজউদ্দৌলা হয়ত সফলতা লাভ করতে পারেন নি। কিন্তু তিনি স্বদেশকে তুলে দেননি সা¤্রাজ্যবাদের হাতে। পরাজয়ের পর তিনি হয়ত নিজের শেষ রক্ষা করার জন্য আপোষ করতে পারতেন; তিনি তার জন্য বিন্দুমাত্র চেষ্টাও করেন নি। শহীদ নবাব সিরাজউদ্দৌলা প্রতিটি দেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের জন্য প্রেরণা এক অমীয় উৎস। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার শাহাদাতকে কবুল করুন। আমীন

সিরাজের অনুগত, দেশপ্রেমিক সেনাপতি ও আমত্যদেরও একে একে হত্যা-নির্যাতনের শিকারে পরিণত করা হয়। ষড়যন্ত্রকারী রায়দুর্লভ বিষ প্রয়োগে হত্যা করেন অকৃত্রিম সিরাজভক্ত মোহনলালকে। খাজা আবদুল হাদি খানকে মীরজাফর মেরে ফেলেন বিশ্বাসঘাতকতা করে। সিরাজ অনুগত ঢাকার ভূতপূর্ব নায়েব রায় বল্লভ সেনকে গঙ্গার জলে ডুবিয়ে মারা হয়। পাটনার নায়েব, আরেক সিরাজ সুহৃদ, রামনারায়ণকেও খুবই নিষ্ঠুরভাবে খুন করা হয়। মোটের ওপর, পলাশীর যুদ্ধের ২০ বছরের মধ্যে প্রায় সকল সিরাজ অনুগত সেনাপতি, আমীর-ওমরাহকে সমূলে নিশ্চিহ্ন করা হয়।

পলাশীর প্রান্তরে পরাজয়ের কারণ :

এত সৈন্য, শক্তি-সামর্থ থাকার পরেও কেন পলাশীর প্রান্তরে মুসলিমদের শোচনীয়ভাবে পরাজয় হয়েছিলো? এর কারণ হলো দুটি।

এক. আমরা শত্রু চিনতে ভুল করি। মীর জাফর বারবার ষড়যন্ত্র করা সত্ত্বেও নবাব সিরাজউদ্দৌলা তাঁর উপর নির্ভরশীল হতে দেখা যায়। হয়তো নবাবের বয়স কম এবং সহজ সরল ছিলেন বলেই। এটা বাঙালির মজ্জাগত স্বভাব। আমরা শত্রু চিনতে বার বার ভুল করি। বিশ্বাসঘাতকদের বার বার বিশ্বাস ভঙ্গের সুযোগ করে দিই।

দুই. এই কারণটা ইতিহাসবিদ উইলিয়াম ড্যালরিম্পল এর মুখেই শুনুন, তার লেখা নতুন বই ‘দ্য অ্যানারকি: দ্য রিলেন্টলেস রাইজ অব দ্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ এ নিয়ে লিখেন, “অলস বাঙালিদের জন্যই পলাশী যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলা হেরে গেছেন।”

এই বিষয়ে রবার্ট ক্লাইভ তার আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, সে দিন স্থানীয় অধিবাসীরা ইংরেজদের প্রতিরোধ করতে চাইলে লাঠিসোটা আর হাতের ইটপাটকেল মেরেই তাদের খতম করে দিতে পারতো। কিন্তু এ দেশবাসীরা তা উপলব্ধি করতে পারেনি। যেকোনো কারণেই হোক সে দিন বাংলার মানুষ এগিয়ে যায়নি। তাদের রাজনৈতিক সচেতনতার তখন খুবই অভাব ছিল।

আসলে আমরা বরাবরই অলস, অসচেতন, স্বার্থপর এবং নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা জাতি। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, পলাশীর ট্র্যাজেডির পরেও বাংলার সাধারণ মানুষ, কৃষক সমাজ দৈনন্দিন জীবন, নিত্যদিনের মতোই মাঠে কৃষি কাজ করেছে। ফসল বুনেছে। অথচ পলাশীর যুদ্ধে গোটা জাতীয় জীবনে কি নিদারুণ ভাগ্য বিপর্যয় ঘটলো, এক ঘণ্টার প্রহসনের যুদ্ধে গোটা জাতির স্বাধীনতা হরণ করে নিয়ে গেল কয়েক বেনিয়া ইংরেজ অথচ তাদের কারো টনক নড়লো না। টনক যখন নড়লো, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাদের আর তখন কিছুই করার ছিল না।

মীর জাফরদের শেষ পরিণতি :

কিন্তু বাংলার ট্র্যাজেডি এই যে, মীরজাফরেরা বারবার গোর থেকে উঠে আসে। একটা কথা বার বার উচ্চারিত হয়, পলাশীর ঐতিহাসিক ঘটনা থেকে আমরা শিক্ষা নিই নাই। কারণ ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নেয়া বাঙালির মজ্জাগত ব্যাপার। এত নির্যাতন, নিপীড়ন চালানোর কুশলীব যারা ছিলেন, তাদের কি পরিণতি হয়েছিলো তা তুলে ধরছি, এতে যদি কেউ শিক্ষা নিই আর কি। বর্তমান ও ভবিষ্যতে পর্দার আড়ালে এমন কিছু করার আগে যেন হাজার বার ভাবতে হয়।

মহান সৃষ্টিকর্তা যে সবকিছুর বিচার করেন, তা আমরা পলাশীর প্রেক্ষাপট তৈরির খলনায়কদের নির্মম পরিণতি দেখে কিছুটা হলেও বুঝতে পারি। সিরাজের হত্যাকারী মোহাম্মদী বেগ উন্মাদ অবস্থায় দাম্পত্য কলহে এক কূপে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে। মীরনের মৃত্যু ঘটেছিল বজ্রপাতে। তার আগে সিরাজের খালা ষড়যন্ত্রকারী ঘসেটি বেগমকে মীরণ প্রবল খরস্রোতা বুড়িগঙ্গায় নৌকা ডুবিয়ে মেরে ফেলে। মীর জাফর ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে দুদুবার বাংলার মসনদে বসেছিলেন। কিন্তু শেষ বয়সে মারাত্মক কুষ্ঠ ব্যাধিতে তার ভবলীলা সাঙ্গ হয়।

মীর কাশিম আলী খান পরবর্তীতে বাঙলার নবাব হয়েছিলেন; কিন্তু শুরুতেই তিনি ছিলেন বাংলার মুসিলম শাসন অবসানের মূল ষড়যন্ত্রের অন্যতম সহযোগী। ভগবান গোলায় নবাবকে তিনি সর্বপ্রথম ধরিয়ে দেন তার শ্যালক মীরণের হাতে। শেষ পর্যায়ে এসে মীর কাশিম অনুধাবন করলেন একদা এই চক্রের সাথে হাত মিলিয়ে তিনি বাঙলার মুসলমানদের স্বার্থের চরম ক্ষতি সাধন করেছেন, এখন আর কোনো উপায় নেই।

মীর কাশিম বুঝলেন ঠিকই, কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। কিন্তু মূল ষড়যন্ত্রকারীরা কি চিরকালই পর্দার অন্তরালে থেকে যাবে? মুঙ্গেরের দুর্গশীর্ষ থেকে বস্তায় ভরে গঙ্গার বুকে তিনি নিক্ষেপ করেন জগৎশেঠ আর রায়দুর্লভের জীবন্ত দেহ। অপর এক অপঘাতে নিহত হলো রাজা রাজ বল্লভ। পরবর্তীকালে তার সব কীর্তি পদ্মা নদী গ্রাস করে কীর্তিনাশা নামধারণ করলো।

কিন্তু এত করেও মীর কাশিম তার শেষ রক্ষা করতে পারলেন না। বক্সারের যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর ইংরেজ কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে বনে জঙ্গলে আত্মগোপন করেই রইলেন। জঙ্গলেই তার দুই ছেলে নিহত হন। নির্বংশ মীর কাশিম আলী খান এরপর কোথায় উধাও হয়ে যান ইতিহাস সে সম্পর্কে নীরব। দীর্ঘ দিন পর তার লাশ পাওয়া যায় দিল্লির আজমেরি গেটের কাছে রাস্তার ওপরে।

ষড়যন্ত্রকারীদের ইংরেজরা প্রায়ই প্রচুর অর্থবিত্ত এবং পদক, পদবি দিয়ে তুষ্ট করত বলে জানা যায়। এ রকম এক পদক বিতরণী অনুষ্ঠানে হাজির হয়েও পদক প্রাপ্ত হিসেবে ডাক না পাওয়ায় অপমানে, ক্ষোভে সভাস্থলে উমিচাঁদের হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান। নন্দকুমার ভূষিত ছিল মহারাজা উপাধিতে কিন্তু ওয়ারেন হেস্টিংসের সাজানো মামলায় আসামি হিসেবে তাকে শেষ পর্যন্ত শেওড়া গাছে ঝুলতে হয় ফাঁসি কাষ্ঠে।

ইয়ার লতিফ নিরুদ্দেশ হয়ে গোপনে মৃত্যুবরণ করেন। রায় দুর্লভ ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়ে কারাগারে ধুকে ধুকে মারা গেছেন।স্ক্যাপ্টন বাংলায় লুটপাট করে বিলেতে ফেরার পথে জাহাজ ডুবিতে মারা যায়। ওয়াটসন কোম্পানির চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়ে মনের দুঃখে ও অনুশোচনায় ক্রমাগত অসুস্থ হয়ে কোনো ঔষুধে প্রতিকার না পেয়ে শোচনীয়ভাবে মৃত্যু বরণ করেন।

এভাবেই দেখা যায় বাংলার মুসলমানদের স্বার্থবিরোধী ভূমিকা পালনকারীদের ইতিহাস কাউকেই ক্ষমা করেনি, চক্রান্তকারীদের ভোগ করতে হয়েছে মর্মান্তিক পরিণতি।

সিরাজউদ্দৌলা কখনো তার দেশের প্রজাদের সাথে কোনো অবস্থাতেই বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। কখনো স্বেচ্ছায় স্বদেশকে বিকিয়ে দেননি। তার চরিত্রেও কোনো কালিমা ছিলো না। পলাশীর প্রান্তরে মর্মান্তি নাট্যমঞ্চে এক মাত্র তিনি ছিলেন মূল নায়ক। সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন বাঙলার স্বাধীনতার শেষ প্রতীক।

লেখক

পরিচালক, মারকাযুস সুন্নাহ, ঢাকা

সেক্রেটারী, সেন্টার ফর রিসার্চ এন্ড কমিউনিটি ডেভেলোপমেন্ট (সিআরসিডি)